বঙ্গোপসাগরে নৌকাডুবিতে নারী ও শিশুসহ ১৪ রোহিঙ্গার মৃত্যু

কামরান রেজা চৌধুরী ও জেসমিন পাপড়ি
2017.09.28
ঢাকা
মিয়ানমারে সব হারিয়ে শুধু শিশু সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসে টেকনাফের জাদিমুড়া পাড়ায় আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা নারী। মিয়ানমারে সব হারিয়ে শুধু শিশু সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসে টেকনাফের জাদিমুড়া পাড়ায় আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা নারী। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

গত এক মাসে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি অনুপ্রবেশ। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে এক নৌকা ডুবিতে বৃহস্পতিবার ১৪ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের ওপর শক্ত পদক্ষেপ নিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড।

বৃহস্পতিবার বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানি সৈকত এলাকায় সাগর থেকে ১৪ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানায়।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্র উপকূল থেকে ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতরা সবাই রোহিঙ্গা বলে শনাক্ত করা গেছে। এদের মধ্যে ৮ শিশু, ৪ জন নারী ও দুইজন পুরুষ।”

এছাড়া আরও দুজন পুরুষ ও দুজন নারীকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে জানান তিনি। এখনো ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছে।

এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইন উদ্দিন।

এর আগে টেকনাফ ও উখিয়ার নাফনদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৩টির বেশি নৌকাডুবির ঘটনায় ১১২ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৫৮ জন শিশু, ৩১জন নারী ও ২৩জন পুরুষ।

উদ্ধার হওয়া একজন রোহিঙ্গা মো. জাফর (২৬) স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার সকালে রাখাইনের বুচিডংয়ের মাইডং এলাকা থেকে ৮০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে একটি নৌকায় ওঠেন। দুপুরে নৌকাটি টেকনাফের নাফ নদী পেরিয়ে সেন্ট মার্টিন উপকূলের কাছাকাছি আসার পরে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টিপাতের কবলে পড়ে।

৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে রোহিঙ্গার সংখ্যা

২৫ আগস্ট থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখ এক হাজার আটশো বলে জানিয়েছে ইন্টার সেক্টর কো অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।

বুধবার নতুন রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ আশি হাজার জানালেও একদিন পরেই প্রায় বাইশ হাজার রোহিঙ্গা যোগ করে এই সংখ্যা জানালো আইএসসিজি।

তবে এরা একদিনের অনুপ্রবেশকারী নয় বরং আগে থেকে অনুপ্রবেশ করলেও গণনা থেকে বাদ যাওয়া শরণার্থী বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর রাজ্যজুড়ে নতুন করে সেনা অভিযানের নামে ব্যাপক হত্যা ও জালাও-পোড়াও শুরু করে দেশটি। এরপর থেকেই রাখাইনের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে।

আশ্রয় না পেয়ে টেকনাফ নাইট্যং পাড়ার রাস্তার পাশে একটি ছাউনিতে বসে আছেন রোহিঙ্গারা। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আশ্রয় না পেয়ে টেকনাফ নাইট্যং পাড়ার রাস্তার পাশে একটি ছাউনিতে বসে আছেন রোহিঙ্গারা। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

সতর্ক থাকার পরামর্শ যুক্তরাজ্যের

মিয়ানমারের ওপর শক্ত পদক্ষেপ নিতে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশের আগে মিয়ানমার সফর করা এই মন্ত্রী জানান, “সব শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সু চি।”

তবে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করে মার্ক ফিল্ড বলেন বলেন, “তিনি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে একটি ‘সঠিক পথ’ বের করার চেষ্টা করছেন।”

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে মার্ক ফিল্ড বলেন, “এটা এখন আর একটি আঞ্চলিক ইস্যু নয়। এই পর্যায়ে আমরা সব ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাব।”

যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ক ডিপার্টমেন্টের প্রতিমন্ত্রী এলিস্টার বার্টও মার্ক ফিল্ডের সফরসঙ্গী ছিলেন।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের জন্য আরও ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড ঘোষণা করেন তাঁরা।

বৈঠকের পরে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “এর আগে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তার ঘোষণা দিয়েছিল। এবার তারা আরও ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”

অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব অ্যামনেস্টির

এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে দেশটির বিরুদ্ধে ‘ব্যাপক ভিত্তিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’সহ সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠককে সামনে রেখে গত বুধবার রাতে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক তিরানা হাসান বলেন, “মিয়ানমারের কাছে সব ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করাসহ দেশটির ওপর এখনই একটি ‘ব্যাপকভিত্তিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করতে হবে।”

রাখাইনে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সফর স্থগিত

সহিংসতা আক্রান্ত রাখাইন রাজ্যে ‘খারাপ আবহাওয়ার কারণে’ বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সফর স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।

আগস্টের শেষ দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর এটিই ছিল জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধি দলের সেখানে যাবার প্রথম কর্মসূচি।

বুধবার মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক এক বিবৃতিতে জানান, “খারাপ আবহাওয়ার কারণে সরকার আয়োজিত সফরটি স্থগিত করে পরের সপ্তাহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,” জানায় এএফপি।

‘রোহিঙ্গা’ পরিচয় নিয়ে সংকট

বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেবার ক্ষেত্রে তাঁদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে বলে বুধবার জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুই সপ্তার বেশি সময় ধরে নতুন আগত রোহিঙ্গাদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র চব্বিশ হাজার রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পেরেছে বলে জানা যায়।

“তাঁরা ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ কথাটার পাশে ‘রোহিঙ্গা’ কথাটাও পরিচয়পত্রে রাখতে চায়,” বৃহস্পতিবার এএফপিকে জানান রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্রের সমন্বয়ক মেজর কবির কিবরিয়া।

তিনি বলেন, “কিন্তু সরকারের সিন্ধান্ত হলো তাঁদেরকে শুধুই ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা।”

“আমরা রোহিঙ্গা। এইটাই আমাদের প্রথম পরিচয়। এটা কেন আমাদের কার্ডে লেখা নেই?” বৃহস্পতিবার রেজিস্ট্রেশন কার্ড হাতে পেয়ে তাতে রোহিঙ্গা কথাটা লেখা না থাকায় এএফপি প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করেন অসন্তোষ্ট নূর হাকিম।

আলোচনা চলছে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে

আজ বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের সময় বিকেল তিনটায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চলমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

২০০৫ সালের পর এই প্রথমবারের মতো পূর্বনির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে এসেছে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। এই নিয়ে এক মাসে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিন দফা বৈঠকে হচ্ছে।

২৩ সেপ্টেম্বর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা নিয়ে এ আলোচনার প্রস্তাব দেয় নিরাপত্তা পরিষদের সাত সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, মিসর, কাজাখস্তান ও সেনেগাল।

রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে বুধবার ঢাকায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে জোরালো পদক্ষেপের অনুরোধও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।