রোহিঙ্গা সংকট: মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নে জাতিসংঘকে প্রধানমন্ত্রীর তাগিদ

জেসমিন পাপড়ি
2018.09.28
ঢাকা
180928_PM-UN_620.jpeg জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তি অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার মৌখিকভাবে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না বলেও বিশ্ব দরবারে অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী।

স্থানীয় সময় ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সাধ্যমতো তাঁদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করেছে।

যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই তার সমাধানও মিয়ানমারে হতে হবে বলেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছেন তা বাস্তব সত্য বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটা নির্ভর করছে মিয়ানমারের উপর। আমরা একটি চুক্তি করেছি। সেটা বাস্তবায়নের পুরো দায়িত্ব মিয়ানমারের।”

“কিন্তু বারবার চেষ্টা করলেও মিয়ানমার কথা রাখে না। ফলে আমাদের সন্দেহ আছে, মিয়ানমার সময় ক্ষেপণ করছে এবং তাদের নাগরিকদের ফেরত না নেওয়ার ব্যাপারে নানা অপকৌশল প্রয়োগ করছে,” বলেন ওই অধ্যাপক।

“ফলে আমরা যতই দেনদরবার করি না কেন, তারা নানা বাহানায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করবে। এখন আমাদের খুব এগ্রেসিভ ডিপ্লোমেসিতে যেতে হবে। যদি আমরা যেতে না পারি তাহলে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে থেকে যেতে পারে,” বলেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

মিয়ানমার মিথ্যাবাদী: রোহিঙ্গাদের প্রতিক্রিয়া

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে চেয়ারম্যান আবদুল মতলব বেনারকে বলেন, “কোনো দিনও সে দেশের সেনারা চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক।”

“বরং তারা বিভিন্ন অভিযোগ তুলে যারা এখনো সে দেশে থেকে গেছে তাদের তাড়াচ্ছে। প্রত্যাবাসনের চুক্তিতে রাজি হলও বাস্তবায়ন কখনো করবে না। তারা শুধু নাটক করে যাচ্ছে, সেই সত্যটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে,” বলেন তিনি।

টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে বসতি করেছেন নুর আলম ওরফে লালু। গত বছরে স্বজন হারিয়ে এপারে পালিয়ে আসা লালু বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সরকার একটি মিথ্যাবাদী সরকার। সে দেশের সেনারা চায় না কখনো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে বসতি করুক। তারা শুধু বলবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া কথা কিন্তু কখনো বাস্তবে ফেরত নেবে না। তাদের মুখের কথা কখনো বিশ্বাস করতে নেই।”

আরও যা বলেছেন শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।’

বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাতে আমরা হতভম্ব। একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে।”

“আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে,” বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা যত দিন তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে না পারবে, তত দিন সাময়িকভাবে তারা যাতে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করতে পারে, সে জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে আমরা নতুন আবাসন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি।”

রোহিঙ্গাদের মানসম্মত পরিবেশে বসবাস নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের উদ্যোগে সহযোগিতার জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্ব শান্তি রক্ষায় অবদান

গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবনদান করেছেন। বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ জন নারীসহ বাংলাদেশের মোট ৭ হাজারেরও বেশি শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীগণ তাঁদের পেশাদারি, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।”

সন্ত্রাস দমনে সাফল্য

বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সব সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আমাদের ‘জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংসদই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সংসদ যেখানে সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার ও বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বর্তমান সংসদে ৭২ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন।

“তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে,” বলেন প্রধানন্ত্রী।

জলবায়ু ‍ঝুঁকি প্রসঙ্গ

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে আমরা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের এক শতাংশ ব্যয় করছি। জলবায়ু সহায়ক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করছি।”

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ও ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন সংরক্ষণে ৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টেকনাফ থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।