বিশ্বের সব চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শরণার্থী সংকট রোহিঙ্গা: জাতিসংঘ প্রধান
2017.09.29
ঢাকা ও কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতায় প্রাণ বাঁচাতে এক মাসে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাকে “বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শরণার্থী সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা” বলে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেস।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকের উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি এই কথা বলেন। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান চালানোর দায়ে মিয়ানমারকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনায় চীন ও রাশিয়ার অবস্থানে ভীষণভাবে হতাশ বাংলাদেশ।
“পরিস্থিতিটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শরণার্থী সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা এবং মানবতা ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে,” বলেন গুতারেস।
রাখাইন রাজ্যে ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার প্রসঙ্গ টেনে তিনি অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ‘মানবাধিকারের দুঃস্বপ্ন’ অবসান ঘটানোর জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান।
মহাসচিব গুতারেস বলেন, “আমি আবারো মিয়ানমারের প্রতি অবিলম্বে তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। প্রথমত, সেনা অভিযান বন্ধ করুন। দ্বিতীয়ত, বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তার সুযোগ দিন এবং তৃতীয়ত, শরণার্থীদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় নিরাপত্তা ও মর্যাদাসহ স্থিতিশীল প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা দিন।”
মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করল যুক্তরাষ্ট্র
নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করতে নিধনযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ তুলেছেন।
“বার্মা (মিয়ানমার) কতৃর্পক্ষের যে আচরণ দেখা যাচ্ছে, আমাদের বলেত দ্বিধা নেই তা একটি জাতিগত সংখ্যালঘুকে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে অব্যাহত অভিযান। এই বিষয়টি বার্মার শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জন্য অবশ্যই লজ্জাজনক, যারা উদার ও গণতান্ত্রিক বার্মার জন্য এক সময় অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন,” বলেন নিকি হ্যালি।
নিকি হ্যালিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো কর্মকর্তা যিনি রাখাইন রাজ্যের চলমান ঘটনাকে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা বা “জাতিগত নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধি বলেন, “এখন নিপীড়ন ও দেশের নাগরিকদের মধ্যে ঘৃণা উসকে দেয়ার কাজে জড়িত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত রাখতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি, হ্যালি জনগণের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
হতাশ বাংলাদেশ, মর্মাহত রোহিঙ্গারা
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীন ও রাশিয়ার আচরণে হতাশ বাংলাদেশ। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো না হলেও শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী পরাশক্তিধর চীনের আচরণকে দ্বিচারিতা বলে উল্লেখ করেছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠানো, অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মিয়ানমারকে সমর্থন করা, এটা চীনের দ্বিচারিতা। এ ধরনের আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়।”
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “রাশিয়ার অবস্থানে আমরা সত্যিই হতাশ। তারা রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর জাতিগত রোহিঙ্গা নিধন এবং গণহত্যা স্বীকার করেনি। রাশিয়ার এই বিবৃতি দেশটির সামরিক বাহিনী এবং উদ্ধত বৌদ্ধদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যয় উৎসাহিত করবে।”
তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও আলোচনার জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানান তিনি।
“জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেবে- এমনটাই আমরা আশা করেছিলাম। যা হয়েছে তাতে রোহিঙ্গারা ভীষণভাবে মর্মাহত,” বেনারকে বলেন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবুদল মোতালেব।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বিকেল তিনটায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনা হয়। তবে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এই দুই সদস্যদেশ।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রের আহবানে এ বৈঠক আয়োজন করা হয়।
‘ইতিবাচক অগ্রগতি’
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ক আলোচনা হওয়াটাকেই একটি ‘ইতিবাচক উন্নয়ন’ বলে মনে করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. তৌফিক আলী।
তিনি বেনারকে বলেন, “যদিও জাতিসংঘে কোনো প্রস্তাব গৃহীত হয়নি তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ আলোচনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিকতা ও নৈতিক নীতিমালাকে প্রতিফলিত করে। এবং এটি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।”
শিশুদের জন্য ১ হাজার ৩ শ স্কুল করবে ইউনিসেফ
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ১৩শ’র বেশি স্কুল স্থাপন করবে ইউনিসেফ। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বর্তমানে কক্সবাজারের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের জন্য ১শ ৮২টি স্কুল পরিচালনা করছে। এসব স্কুলে ১ হাজার পাঁচশ’র মতো শিশু পড়ালেখা করছে বলে শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
এতে জানানো হয়, আগামী বছরের মধ্যে পরিধি বাড়িয়ে ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এই কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।
ইউনিসেফের স্কুলগুলোতে ৪ থেকে ৬ বছরের শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা এবং ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রতি শিফটে ৩৫ শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রতিটি স্কুল তিন শিফটে চালানো হয়।
এসব স্কুলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ, বিজ্ঞান এবং মানবিক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। রয়েছে শিশুদের স্বাস্থ্যগত ও জীবনমুখী দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য মানসিক কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থাও। এসব শিশুদের মাঝে বই, কলম, পেন্সিল, রং পেন্সিল, স্কুল ব্যাগসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে ইউনিসেফ।
বঙ্গোপসাগরে নৌকা ডুবির ঘটনায় নিহত ২৩
এদিকে বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম।
ওই নৌকার মোট ৮০ জন আরোহীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে ওই বিবৃতিতে জানানো হয়।
প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবার বিকেলে উখিয়ার ইনানী সৈকতের এক কিলোমিটার দক্ষিণে পাটোয়ারটেক উপকূলের কাছে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কবলে পড়ে ডুবে যায় শিশু, নারীসহ ৮০ জন রোহিঙ্গাবাহী ইঞ্জিনচালিত ওই নৌকাটি।