রোহিঙ্গাদের ‘গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ’ করবে সেনাবাহিনী
2019.09.30
ঢাকা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের `গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ’ করবে বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
সোমবার চট্টগ্রামের হালিশহরে সেনাবাহিনীর চার গোলন্দাজ ইউনিটকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান সেনাপ্রধান।
শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘রোহিঙ্গা সংকট শরণার্থী শিবিরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে’ বলে মন্তব্য করার দুই দিন পর জেনারল আজিজ এই মন্তব্য করলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালানো ঠেকাতেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্দ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে কবে নাগাদ বেড়া নির্মাণ শুরু হবে সেব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালানো ঠেকাতে ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে।”
তিনি বলেন, এই দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া হবে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়ার সুপারিশ করা হয় বলে বেনারকে জানান কমিটির সদস্য কর্নেল ফারুক খান।
এদিকে শরণার্থী শিবিরে কাঁটাতারের বেড়া দেবার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাই এই প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে বেনারকে জানান শরণার্থী কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার।
উল্লেখ্য, বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে কাঁটাতারের বেড়া
চট্টগ্রামে চার গোলন্দাজ ইউনিটকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদান অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সেনাপ্রধানকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
সেনাপ্রধানকে উদ্ধৃত করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিচালক লেঃ কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বেনারকে বলেন, “সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশের কাঁটাতারের বেড়া দেবার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। আমরা সেটার পরিকল্পনা করছি। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের গতিবিধি যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য আমরা কাজ করব।”
সেনাপ্রধান বলেন, “বাংলাদেশ এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের কোনো ধরনের উস্কানির ফাঁদে পা দেবে না সেনাবাহিনী।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা শরণার্থী। মানবিক কারণে আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের ধরছে পুলিশ।”
তিনি বলেন, “ক্যাম্প থেকে তাঁদের পালানো ঠেকাতে শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তাঁর নির্দেশনা পেলেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু হবে।”
কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমি বলেছি, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার কারণেই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা জরুরি।”
তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতেরা সরকারের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। লাখ লাখ মানুষ, কাজ নেই, কোনো ভবিষ্যত নেই। এখানে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি রয়েছে। সুতরাং, তাঁদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।”
তিনি বলেন, “সেনাবাহিনী গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের কাজ সুচারু রূপে করতে সক্ষম। সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী দিয়ে সেটি করা প্রায় অসম্ভব।”
রোহিঙ্গাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তাঁদের বড় অংশ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিরোধী।
কুতুপালং চার নম্বর ক্যাম্পের হেডমাঝি আব্দুর রহিম বেনারকে বলেন, “কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আলাপ- আলোচনা হচ্ছে। অনেকে এটার বিরুদ্ধে মত দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “চারপাশে বেড়া দিলে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর বিষয়টি একটু কমতে পারে। তবে পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়।”
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারি মো. ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সরকার ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্বান্ত নিলে, সেখানে আমাদের বলার কিছু নাই। আমরা চাইলেও দিবে, না চাইলেও দিবে। তবে বেড়া দিয়ে ইতিবাচক কোনো সুফল আসবে না।”
তিনি বলেন, “কারণ জোর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গারা এসব বুঝবে না। বরং এটার সুফল, কুফল সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের আগে বোঝাতে হবে। তাহলেই কিছুটা সুফল আসতে পারে।”
ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, “আমরা মিয়ানমারে যেখানে ছিলাম, সেখানেও কাঁটাতারের বেড়া ছিল। কিন্তু সেই বেড়া ছিঁড়ে আমরা এতগুলো মানুষ এখানে চলে এসেছি। তাই বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখার চেয়ে সবাইকে কাউন্সেলিং করা জরুরি।”
প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে সহয়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া।