মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘বিকৃত তথ্যের প্রচারণা’ চালানোর অভিযোগ বাংলাদেশের
2020.09.30
ঢাকা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যহত করতেই মিয়ানমার জঙ্গি সংগঠন আরসা ও আরাকান আর্মি বাংলাদেশকে অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ‘বিকৃত তথ্যের প্রচারণা’ চলাচ্ছে, বুধবার বেনারের কাছে এমন মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে মিয়ানমারের ইউনিয়ন মন্ত্রী চ তিন্ত সোয়ে বলেন, “আরসা ও আরাকান আর্মি বাংলাদেশের ভূমি অভয়ারণ্য হিসাবে ব্যবহার করছে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জটিল করে তুলেছে।”
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, “কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে আরসা এবং তাদের সমর্থকরা যাতে হুমকি ও সহিংসতার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে না পারে সেব্যাপারে জোর দিতে হবে। কারণ এধরনের ব্যবহার বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশের জন্য হুমকি।”
এর প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “আরসা এবং আরাকান আর্মি বাংলাদেশের ভূমি অভয়ারণ্য হিসাবে ব্যবহার করছে বলে মিয়ানমার যে অভিযোগ করছে, সেটি আসলে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বিকৃত তথ্য প্রচারণা মাত্র।”
“এর উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ব্যহত করা। আমরা তাদের এই অভিযোগ অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রত্যাখান করি,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
“মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তরিক নয়” মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সেকারণেই তারা সন্ত্রাসী সংগঠনকে আশ্রয়প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ করছে।”
“বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি করার নীতিতে বিশ্বাস করে না,” জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি মিয়ানমারকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এধরনের অসত্য প্রচারণা বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।”
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস রাখাইনে ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকলেও মিয়ানমার তাঁদের ফেরত নিচ্ছে না জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, “রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে যাতে নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে রোহিঙ্গারা তাঁদের নিবাসে ফিরে যেতে পারে।”
এদিকে মিয়ানমার বছরের পর বছর ধরে ‘পদ্ধতিগতভাবে ও সূচারুরূপে’ এধরনের মিথ্যা অভিযোগ করে আসছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “এধরনের কাজের পেছনে মূল কৌশল হলো, রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামতকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা।”
তাঁর মতে বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের এই অভিযোগের জবাব দেয়া।
এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশ ১১ লাখ মিয়ানমারের বাস্তচ্যূত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি। এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। এবং এর সমাধানও মিয়ানমারের কাছে আছে।
শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে জঙ্গিদের উপস্থিতি নেই
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান বৌদ্ধদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির কোনো উপস্থিতি নেই জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন “সকল ধরনের সন্ত্রাসের ব্যাপারে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে।”
“আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ কোনো প্রতিবেশীর ক্ষতি করবে, সেটি আমরা হতে দেবো না,” মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, আরসা অথবা আরাকান আর্মির মতো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন বাংলাদেশে প্রশ্রয় পাবে না। বাংলাদেশে আরসা অথবা আরাকান আর্মির কোনো উপস্থিতি নেই।”
মিয়ানমারের মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিবির ও আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কাজেই, আরসা ও আরাকান আর্মি বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করছে এই অভিযোগের কোনো সত্যতা অথবা ভিত্তি নেই।”
এদিকে “রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমার পুরো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সন্ত্রাসী হিসাবে প্রচার করছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান।
তিনি বলেন, “এধরনের প্রচারণার প্রধান কৌশল হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে নষ্ট করা। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় হলো যে, এখন আমাদেরকে লক্ষ্য করে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।”
“আমরা দৃঢ়ভাবে এধরনের মিথ্যা প্রচরণার নিন্দা জানাই,” বলেন ফারুক খান।
সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি স্বীকার না করলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার দায়ে ‘বেশ কয়েকজনকে’ গ্রেপ্তারের কথা বেনারকে জানিয়েছিলেন।
এছাড়া ২০১৭ সালের নভেম্বরে বেনারনিউজ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এক স্বঘোষিত আরসা সদস্যের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তখন অন্তত ১৫০ জন আরসা সদস্য ছিলেন বলে সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন ওই তরুণ।
মিয়ানমারের অভিযোগ ‘হাস্যকর অতিরঞ্জন’
আরসা ও আরাকান আর্মি সম্পর্কে মিয়ানমারের অভিযোগকে ‘হাস্যকর অতিরঞ্জন’ বলে মন্তব্য করেন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাকারি আবুজা।
তিনি বেনারকে বলেন, “আরসা কখনোই শক্তিশালী সংগঠন ছিল না। একটি টুইটার অ্যাকউন্ট সম্বল করা এই দুর্বল জঙ্গি গোষ্ঠীটির কাছে তেমন কোনো অস্ত্রও নেই।”
তবে রাখাইন বৌদ্ধদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান আর্মির প্রতি মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন বলে জানান আবুজা।
“আরাকানিরা মিয়ানারের স্বীকৃত নাগরিক, যা রোহিঙ্গারা নয়,” জানিয়ে আবুজা বলেন, “এর ফলে আরাকান আর্মির পক্ষে মিয়ানমার সরকারের সাথে দর কষাকষির সুযোগ রয়েছে। যদিও শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের রেকর্ড মারাত্মক নেতিবাচক।”
রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস রাখাইনই আরাকান আর্মির বিচরণ ক্ষেত্র উল্লেখ করে আবুজা বলেন, “আরাকান আর্মি সুসজ্জিত এবং সামরিকভাবে ক্ষিপ্র। অন্যদিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী অথবা বাংলাদেশিরা আরসাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন কোনো প্রমাণও নেই।”
“তাই আমার মনে হয়, মিয়ানমার সরকারের এইসব অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ারই আরেকটি কৌশল মাত্র,” বলেন আবুজা।