রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা: পরিবার আরসাকে দায়ী করলেও পুলিশের ভিন্নমত
2021.09.30
কক্সবাজার ও ঢাকা

আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫:৩০
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মো. মুহিব উল্লাহকে (৫০) হত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা’র সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে অভিযোগ তুলেছেন নিহতের ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ।
তবে বাংলাদেশে আরসা নামের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই দাবি করে পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে—এমন কয়েকজন সন্দেহভাজনের নাম রয়েছে তাদের কাছে। যদিও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হত্যায় জড়িতদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ সশস্ত্র সংগঠন আরসা (পূর্বের নাম আল-ইয়াকিন) শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে নিরুৎসাহিত করতে সক্রিয় থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বরাবরই এ বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার পর বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে দাফন সম্পন্ন হয় গুলিতে প্রাণ হারানো রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী মুহিব উল্লাহর। জানাজায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।
জানাজায় অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা আব্দুল হাকিম জানান, “মুহিব উল্লাহর চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বিরাট ক্ষতি। এ ক্ষতি কোনোভাবে পূরণ হবে না।”
“আমাদের মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেছে, আমরা তাঁর মতো নেতা আর পাব না,” বেনারকে বলেন আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ জমিল।
বুধবার রাতে কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের মধ্যে লম্বাশিয়ায় অবস্থিত সংগঠনের কার্যালয়ে ঢুকে খুব কাছ থেকে মুহিব উল্লাকে লক্ষ্য করে গুলি করে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা। ঘটনার পর রাত সাড়ে ৮ টার দিকে কার্যালয় থেকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবকে মৃত ঘোষণা করেন।

অভিযোগ আরসার বিরুদ্ধে
নিহত মুহিবুল্লাহ’র ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বেনারের সাথে আলাপকালে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “মুহিব উল্লাহর ওপর হামলা চালানো বন্দুকধারীদের এ দলে যারা ছিল, তারা সবাই আরসা সদস্য।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে কাজ করত বলেই তার ভাই ‘আরসা’ সদস্যদের শত্রু হয়ে উঠেছিলেন।
“ক্যাম্পে প্রত্যাবাসন বিরোধী ‘আরসা’ গ্রুপ রয়েছে, তারাই এই হত্যার সাথে জড়িত। হত্যাকারীরা মুখে মাস্ক পরা ছিল, তাই সবাইকে চিহ্নিত করা যায়নি। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ঘাতকদের শাস্তির দাবি জানাই,” যোগ করেন হাবিব।
“এ ঘটনায় আমাদের মনে হচ্ছে, আমার ভাই রোহিঙ্গাদের নেতা, রোহিঙ্গাদের কাছে সে খুব জনপ্রিয়। সেই কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য কোনো কারণ নাই বা কারও সাথে তার অন্য বিরোধ বা লেনদেন নেই,” যোগ করেন হাবিব উল্লাহ।
ভাইকে খুনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে চিনতে পেরেছেন দাবি করে হাবিব বলেন, “সরকারের লোকজনকে আমরা যদি নাম বলি, তাহলে হুমকিতে পড়ব। এখানে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাই।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হক বেনারকে বলেন, “এখানে আরসা বা আল-ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই।”
তিনি বলেন, “আপাতত ক্যাম্পে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবে এ ঘটনাকে ঘিরে যাতে ক্যাম্পে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে।”
“এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ক্যাম্পে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং দলীয় কোন্দলসহ আর কোনো কারণ আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে,” বলেন নাঈমুল।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, “হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যা যা থাকতে পারে, সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে আমরা কিছু নাম পেয়েছি, সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এদিকে, আরসা’র পক্ষ থেকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় মুহিব উল্লাকে খুনের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করা হয়েছে।
মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের আরসাকে দায়ী করে তাঁর ভাইয়ের অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বৃহস্পতিবার বেনারের পক্ষ থেকে আরসার টুইটার পেজে বার্তা পাঠিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতেই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে উখিয়া থানায় নিহতের ছোট ভাই হাবিব হত্যা মামলা দায়ের করেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন এএসপি রফিকুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে অন্য দিনের তুলনায় ভিন্ন চিত্র। সেখানে এপিবিএন, পুলিশ ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে। দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে এবং দাতা সংস্থার লোকজন অন্য দিনের তুলনায় তিন ঘণ্টা আগে ক্যাম্প ত্যাগ করেন। পাশাপাশি বাইরে কোনো লোকজনকে ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
ক্যাম্পে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করার কথা উল্লেখ করে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী নেত্রী জামালিদা বেগম জানান, “এ হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এই ঘটনার ফলে প্রত্যাবাসন আবারও থমকে যেতে পারে।”
দুঃখ প্রকাশ, বিচার দাবি
মুহিব উল্লাহ হত্যার ঘটনাকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য বিরাট ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ্য করে এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং সহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার কর্মীরা।
মুহিব ২০১৯ সালে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে রোহিঙ্গা বিষয়ক অভিজ্ঞতা বিনময় করেছেন জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, “মুহিবুল্লাহ বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার বিষয়ক অ্যাডভোকেট ছিলেন।”
মুহিব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দায় নিশ্চিত করতে “পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ” তদন্তের আহ্বান জানান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এক টুইট বার্তায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেছেন, “মুহিব উল্লাহ ছিলেন রোহিঙ্গাদের জন্য একজন সাহসী যোদ্ধা, যিনি সোচ্চার ছিলেন রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে। আমরা তাঁর হত্যাকাণ্ডে শোকাহত ও মর্মাহত। আমি আশা করছি অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসবে।”
টুইট বার্তায় ডিকসন লিখেছেন, “মুহিব উল্লাহর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো।”
বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আন্নে গেরার্ড ভেন লিউইন টুইটে লিখেছেন, “রোহিঙ্গা নেতা হত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত ও ব্যথিত। আমি তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আশা করি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।”
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকা কার্যালয় এক টুইটে লিখেছে, “হত্যাকাণ্ডে ইইউ মর্মাহত ও শোকাহত। তাঁর পরিবার, বন্ধু ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য এটি মর্মান্তিক ক্ষতি। আমরা আন্তরিক সমবেদনা জানাই।”
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার মুহিব উল্লাহ “বৈশ্বিক পর্যায়েও” পরিচিত মুখ ছিলেন জানিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের মুখপাত্র ড্যানিয়েল সুলিভান বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
মুহিব উল্লাহর সাথে একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে জানিয়ে সুলিভান বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার “এই কণ্ঠটির অভাব বোধ করবে সবাই।”
এই ঘটনার পর বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা অন্যান্য রোহিঙ্গা নেতাদেরও হুমকির বিষয়টি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন সুলিভান।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী ও রাখাইনের বুথিডং শহরের সাবেক জনপ্রতিনিধি সো মং ওরফে আব্দুল রাজ্জাক ২০১০ সাল থেকেই ব্যক্তিগতভাবে মুহিব উল্লাহকে চিনতেন জানিয়ে রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, “তাঁর মৃত্যুসংবাদ শোনাটা ছিল খুবই মর্মান্তিক।”
মুহিব উল্লাহ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাঁর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিষয়ে তদন্তের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য হুমকি পাওয়ার কথা সে আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু কখনো বলেনি হত্যার হুমকিও পেয়েছিল সে।”
“আমি মনে করি মুহিব উল্লাহ হত্যার পেছনে জড়িতরা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলতেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে,” বলেন রাজ্জাক।
শরণার্থী শিবিরের অপরাধী চক্রগুলো রোহিঙ্গা শিবির থেকে চাঁদা তোলা, শিবিরকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্নভাবে লাভবান হয় উল্লেখ করে রাজ্জাক বলেন, “তারা কখনোই চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরে যাক।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে রেডিও ফ্রি এশিয়ার বার্মিজ সার্ভিস।
আপডেট: মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি প্রতিবেদনে যোগ করা হলো।