বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস মিয়ানমারের
2017.10.02
ঢাকা

সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার। এ লক্ষ্যে একটি যৌথ ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের সঙ্গে একমত হয়েছে দেশটি।
ঢাকা সফররত মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। তবে পরিকল্পিত প্রত্যাবাসন সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি তিনি।
এদিকে সোমবার প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সরকার সহিংসতা আক্রান্ত রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে এক দিনের পরিদর্শনে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা রক্ষীদের চৌকিতে সন্ত্রাসীদের হামলার অজুহাতে দেশটির সেনাবাহিনী সেখানে দমন অভিযানের নামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এতে ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চেষ্টার অভিযোগ তুলেছে। এই পরিস্থিতে এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ঢাকায় আসে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে। মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।
বৈঠকের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “তারা (মিয়ানমার) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে।”
“সামগ্রিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানের জন্য উভয় পক্ষ যৌথ ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করতে সম্মত হয়েছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, “প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করা হয়। ওই চুক্তির খসড়া মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে হস্তান্তর করা হয়েছে।”
“উভয় দেশই শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে একমত হয়েছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ কবে নাগাদ গঠন হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ না হলেও সেটা খুব শিগগিরই হবে বলে জানান তিনি।
তবে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলে বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন। এদিকে বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেনারনিউজের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মিয়ানমার দূতাবাসের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়েও মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খুব শিগগির মিয়ানমারে যাবেন।”
রোববার দিবাগত রাত ১২.৫০ মিনিটের দিকে সংক্ষিপ্ত সফরে থাই এয়ার ওয়েজের একটি বিমানে ঢাকা পৌঁছান অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী সোয়ে এবং তার প্রতিনিধিদল।
দুপুর ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে বৈঠক শুরু করে দুপক্ষ। প্রায় দেড়ঘণ্টাব্যাপী বিভিন্ন বিষয়ে দুপক্ষ আলোচনা করে বলে বেনারকে জানান বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা।
এরপরে বেলা দেড়টার দিকে কড়া পুলিশি পাহারার মধ্য দিয়ে বৈঠকস্থল ত্যাগ করেন মিয়ানমার প্রতিনিধিরা।
সোমবার রাতেই থাই এয়ারওয়েজের একটি বিমানে দেশে ফিরে যাবার কথা রয়েছে প্রতিনিধিদলটির।
‘ইতিবাচক অগ্রগতি’
মিয়ানমারের মন্ত্রীর সফরকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন দেশটিতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা।
তিনি বেনারকে বলেন, “এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। ইতিবাচক এই অর্থে যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে।”
“তবে এর জন্য সময় প্রয়োজন। নির্দিষ্ট কোনো সময়ের মধ্যে কোনো ফলাফল আশা করা যায় না,” বলেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
রাখাইনে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল
এদিকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘ প্রতিনিধি, ত্রাণ সংস্থা ও বিদেশি কূটনীতিকদের একটি দলকে সহিংসতা আক্রান্ত রাখাইন রাজ্যের মংডুতে সোমবার পরিদর্শনে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।
পর্যবেক্ষকদের তিনটি দলে ভাগ করে মংডুর তিনটি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে মংডুর জেলা প্রশাসক হি টাট এর বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থাটি জানায়।
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমালোচানার মুখে মিয়ানমার সরকার এই প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো প্রতিনিধিদলকে সেখানে যাবার অনুমতি দিলো।
মিয়ানমার সরকারের আয়োজনে ও তত্ত্বাবধানে এই পর্যবেক্ষণটি গত সপ্তায় হওয়ার কথা থাকলেও আকস্মিকভাবে তা খারাপ আবহাওয়ার অজুহাতে বাতিল হয়ে যায়।
প্রতিনিধিদল সহিংসতায় নিহত হিন্দু, ম্রো ও থাইখমা সংখ্যালঘুদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করবেন। এছাড়া মংডুর রথিডং এলাকায় এখনো দেশ না ছাড়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথেও দেখা করবেন বলে স্থানীয় পুলিশ অফিসার মো জো এর বরাত দিয়ে জানায় এপি।
৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চায় ইউনিসেফ
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ৭৬ দশমিক ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চেয়েছে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ। সোমবার এক প্রেস বিবৃতিতে এ দাবি জানায় সংস্থাটি। এই অর্থ নতুন আসা রোহিঙ্গা শিশুদের পাশাপাশি সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশের আগে প্রবেশ করা অসহায় শিশুদের মানবিক সহায়তায় ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়। এখন পর্যন্ত যাদের সংখ্যা সাত লক্ষ ২০ হাজার বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
ইউনিসেফ জানায়, গত ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ আসা পাঁচ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শিশু বলে ধারণা করা হচ্ছে।
"প্রতিদিন মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার ও আতঙ্কিত শিশু এবং তাদের পরিবারের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রয়েছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব আমাদের আমাদের সহায়তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত কম,” কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক এন্থনি লেক।
ইউনিসেফ জানায়, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং উন্নত স্বাস্থ্যবিধি প্রসারের লক্ষ্যে এ সাহায্যের আবেদনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তা ছাড়া ডায়রিয়া এবং অন্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শিশুর পোলিওর মতো রোগের টিকা দেওয়া নেই।
রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিসেফের পূর্ববর্তী ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানবিক সহায়তা আবেদন সম্প্রসারিত করা হয়েছে।