‘রোহিঙ্গা’ নয়, ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বলবে বাংলাদেশ
2017.10.05
ঢাকা

নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্প সম্প্রসারিত করে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে আসার সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া।
এদিকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দেবে না এবং এখন থেকে তাঁদেরকে ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ হিসেবে উল্লেখ করবে বলে ওই সম্মেলনে জানান মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল।
“এক চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের ‘রোহিঙ্গা’ নয়, ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বলতে হবে,” সাংবাদিকদের বলেন সচিব শাহ কামাল।
সচিব আরও বলেন, “আমরা তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) রিফিউজি (শরণার্থী) বলছি না। এই পরিচয়ের (বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক) কারণে ধরে নেওয়া হচ্ছে তাঁরা রিফিউজি নয়, তারা আমাদের এখানে আশ্রয় প্রার্থী।”
“দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের ফেরত পাঠাব। দেশের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
গত ২৫ আগস্ট থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া।
সকল রোহিঙ্গা থাকবে কুতুপালংয়ে
বর্তমানে ২৩টি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে এক স্থানে এনে রাখার সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেন জানান ত্রাণমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “নতুন আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের উখিয়ার কুতুপালং এ অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। এর আগে ২৩টি ক্যাম্পে থাকা দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গাকেও এখানে একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকল রোহিঙ্গাকেই কুতুপালংয়ে নিয়ে আসা হবে।”
এ জন্য আরও এক হাজার একর জমি বাড়িয়ে মোট তিন হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, “ইতিমধ্যে ২৩টি ক্যাম্পের মধ্যে ২টি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এই মাসের মধ্যে সব রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।”
ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ি এলাকা ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনার কাজও শুরু হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
“ক্যাম্পের ভেতরের নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, খাদ্য সরবরাহ, স্যানিটেশন, রেজিস্ট্রেশন, চিকিৎসাসহ সকল কাজ সুচারুভাবে করার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ পর্যন্ত ৬১ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করি দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সকল নাগরিককে নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।”
“আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ক্যাম্পের ভেতর নতুন পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন এবং পর্যাপ্ত আনসার মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের নতুন একটি ইউনিট স্থাপন করা হবে,” বলেন তিনি।
জিহাদি ভিডিওসহ যুবক আটক
এদিকে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী এলাকা থেকে জঙ্গি উসকানিমূলক ভিডিও প্রচার, প্রদর্শন ও স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে বিতরণের দায়ে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ( র্যাব)।
র্যাব ৭ এর কক্সবাজার কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তার নাম মো. কামাল হোসেন (৪০)। সে একই এলাকার মৃত আহমদ হোসেনের ছেলে। সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করে তাকে উখিয়া থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
মেজর রুহুল আমিন বলেন, “কামাল হোসেন দীর্ঘদিন যাবৎ জিহাদি ভিডিও প্রচার করত বলে র্যাবের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সে নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে এসব প্রচার করত।”
তবে সে কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান র্যাবের এই কমান্ডার।
বুধবার রাত সাড়ে ১০ টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান র্যাব কর্মকর্তারা।
এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উখিয়া ও টেকনাফে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরাজুল হক টুটুল।
“সন্ত্রাসী, অপপ্রচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে সাদা পোশাকের পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-গোয়েন্দারাও কাজ করছে,” বলেন তিনি।
আফরাজুল হক টুটুল বলেন, “বহিরাগতদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য কার্ডধারী ছাড়া রোহিঙ্গা বসতিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি ত্রাণের নামে যাতে কোনো মহল সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে না পারে তাই সন্ধ্যার পর ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যা
মিয়ানমার আশ্বাস দিলেও শিগগিরই চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা সহসাই সমাধান হবে না বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এমন অবস্থায় বুধবার এক বৈঠকে রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জোর সুপারিশ করা হয়েছে।
“আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে রোহিঙ্গারা শিগগিরই রাখাইনে ফিরে যাবে না। তাই, আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরি করতে চাই, যাতে তারা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে না যায়,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি টিপু মুন্সী।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছেই। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবন জেলায় নয় থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, রোহিঙ্গাদের চাপে কক্সবাজারের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অধিক উপস্থিতিতে স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘ভঙ্গুর’ হয়ে পড়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
উপস্থাপিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ ইতিমধ্যে এসব জেলা থেকে পাঁচ শ ১৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়েছে।
টিপু মুন্সী বলেন, “রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাতে কোনোভাবে ইয়াবা বা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে বিশেষ নজরদারি চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে।”
“যে সুপারিশগুলো এসেছে, সেগুলো আমরা বিবেচনা করব,” বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, যিনি এই কমিটির একজন সদস্য।
তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী