মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন: রাখাইনে ‘বর্ণবাদের’ শিকার লাখের বেশি মুসলমান
2020.10.08
ঢাকা

আপডেট: ৮ অক্টোবর ২০২০। ইস্টার্ন সময় বিকাল ০৫:১৫
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাসহ এক লাখ ৩০ হাজার মুসলমানকে যেভাবে মানবেতর অবস্থায় একটি ‘উন্মুক্ত কারাগারে’ আটকে রাখা হয়েছে তা ‘বর্ণবাদের’ সামিল বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
“অন্তহীন উন্মুক্ত কারাগার: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গণ অন্তরীণ” শিরোনামে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, পুরো এশিয়ার মধ্যে রাখাইনেই প্রথম বর্ণবাদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এতে বলা হয় রাখাইনের বর্ণবাদকে দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ ধরনের বর্ণবাদ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমতুল্য।
২০১২ সালের জুন ও অক্টোবর মাসে রাখাইনের রাজধানী সিত্তে ও এর দক্ষিণাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে দুই দফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ২৮০ জন নিহত হন এবং বাস্তুচ্যুত হন এক লাখ ৩০ হাজার সংখ্যালঘু মুসলমান।
তখন থেকেই ঘরবাড়ি হারানো ওই সকল রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিমদের অস্থায়ী শিবিরে মানবেতরভাবে আটক রাখা হয়, যেখান থেকে আর কোনোদিনও তাঁদের নিজেদের ঘরবাড়িতে যেতে দেয়া হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিবির থেকে কাউকে বাইরে যেতে দেয়া হয় না। কাউকে শিবিরের বাইরে পেলে চলে নির্যাতন-নিপীড়নসহ যাচ্ছেতাই ব্যবহার। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আদায় করেন টাকা পয়সা। সেখানকার আবালবৃদ্ধবনিতা অপুষ্টির শিকার। নেই কোনো স্বাস্থ্য, শিক্ষা অথবা জীবিকার সুযোগ।
২০১৭ সালে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন কমিশন এই সকল অস্থায়ী শিবিরগুলো সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করে। মিয়ানমার সরকারও অস্থায়ী শিবিরগুলো সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। তবে এখনো সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
স্বাভাবিক জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। তাঁরা সংস্থাটিকে বলেছেন, এটিই তাদের নিয়তি, চিরস্থায়ী। এখান থেকে মুক্তি নেই তাঁদের।
এইচআরডব্লিউ এর মতে, “সেখানকার অবস্থা বর্ণবাদ ও নিপীড়নের মতো আন্তর্জাতিক মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমতুল্য। পুরো এশিয়া অঞ্চলে এটিই প্রথম বর্ণবাদী অবস্থা।”
সংস্থাটির মতে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের নেয়া বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের একটি চুক্তি গৃহীত হয়। এই চুক্তিতে কোনো রাষ্ট্রে একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর আরেকটি জাতিগোষ্ঠীর খবরদারিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল ধরনের অমানবিক কাজকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে মিয়ানমার এই আইনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়।
এইচআরডব্লিউ বলছে, “নিদেনপক্ষে ২০১২ সাল থেকে হিসাব করলেও দেখা যাবে যে, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের সিদ্ধান্তগুলো পদ্ধতিগত ও ব্যাপকভাবে নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে। এগুলোর অনেকগুলোই রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিফলন।”
অং সান সু চির সরকার ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে এই নীতির জন্য দায়ী করে সংস্থাটি বলেছে, “তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্থায়ী শিবিরগুলোর অবস্থা নিপীড়নমূলক করে রেখেছে যাতে রোহিঙ্গাদের জীবন মানবেতর হয়।”
জাতিসংঘ ও বিদেশি সরকারগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে তাদের নীতি পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়ে সংস্থাটি বলছে, “রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে। তার পাশাপাশি এই বৈষম্যমূলক নীতির জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হবে।”
রাখাইনে ‘খুব কষ্টে’ আছেন রোহিঙ্গারা
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিমদের নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনকে সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “সত্য কথা বলতে কি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নাজিরা যেভাবে ইহুদিদের আটকে রাখত, নির্যাতন করত, হত্যা করত, মিয়ানমার সরকার ঠিক সেই কাজটিই করছে তার দেশের মুসলিমদের ওপর। এটি প্রকৃতই বর্ণবাদ সেব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”
জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী এ ধরনের কাজ “মানবতার বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধ” জানিয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভালো কাজ করেছে; বিষয়টিকে সামনে এনেছে। অন্যথায় মিয়ানমার যে এই কাজ করছে বিশ্ববাসী এব্যাপারে জানতে পারত না।”
তাঁর মতে, “জাতিসংঘের প্রভাবশালী দেশগুলো চাইলে মিয়ানমারকে এই অবস্থার জন্য জবাবদিহি করতে পারে।”
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো সরিয়ে ফেলার কথা বললেও সেগুলো এখনো সরানো হয়নি মন্তব্য করে শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন দরকার। কারণ, সেখানে পরিস্থিতি ভালো না হলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে রাজি হবে না।”
এদিকে রাখাইনে এবং সেখানকার অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা “খুব কষ্টে আছেন,” মন্তব্য করে কুতুপালং এর শরণার্থী নেতা মৌলভি সৈয়দ আলম বেনারকে বলেন, “অসুখ-বিসুখ হলে তারা ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছে না, নিয়মিত খাবার পাচ্ছে না। অনেকটা অনাহারে মানবেতর দিন কাটছে তাদের।”
এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেবে “তা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “মিয়ানমারে যারা আছে তাদের আগে নাগরিকত্ব দিয়ে আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেই আমরা নিজ দেশে ফিরে যাব। এর আগে নয়।”
তবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটি সম্পর্কে অবগত নন জানিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
এদিকে এখন পর্যন্ত এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদন সম্পর্কে মিয়ানমার সরকার কোনো মন্তব্য করেনি।
কক্সবাজার থেকে প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া।