রোহিঙ্গা শিবিরের সহিংসতায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা

শরীফ খিয়াম
2020.10.08
ঢাকা
201008_Rohingya-violance_Follow-up_1000.jpg উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে রোহিঙ্গাদের দুটি দলের সংঘর্ষের সময় ঘরে লাগিয়ে দেওয়া আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন শরণার্থীরা। ৭ অক্টোবর ২০২০।
[এএফপি]

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনায় বৃহস্পতিবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর)।

উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে টানা পাঁচ দিন ধরে চলা ওই সংহিসতায় অন্তত আটজন মারা গেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিবিরগুলোতে এক দিনের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল সাহায্য সংস্থাগুলো।

বৃহস্পতিবার নতুন কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া না গেলেও রোহিঙ্গাদের দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভেতর গত শুক্রবার থেকে বুধবার পর্যন্ত চলা সংঘর্ষের সময় দুটি খ্রিস্টান রোহিঙ্গা পরিবারের সাত সদ্য ‘অপহৃত’ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

“বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ইউএনএইচসিআর। সহিংসতা প্ররোচিত ও সংঘটিত করার জন্য দায়ীদের অবশ্যই বাংলাদেশের আইনে গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে,” বৃহস্পতিবার এক লিখিত বিবৃতিতে বেনারকে বলেন ইউএনএইচসিআর ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা সাজ্জাদ হোসেন।

ইউএনএইচসিআর’র মতে, করোনা মাহামারি শিবিরগুলোতে শরণার্থীদের কষ্ট এবং সুযোগের অভাবকে আরও তীব্র করে তোলায় তা উত্তেজনা ও অপরাধ বাড়াতে সাহায্য করছে।

“শরণার্থীদের মিয়ানমারে তাঁদের বাড়িতে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে অগ্রগতির অভাব শিবিরগুলোয় অনিশ্চয়তা ও হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতি তৈরিতে অবদান রেখেছে,” বলেন মোস্তফা সাজ্জাদ হোসেন।

সহিংসতা থেকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল জানিয়ে ইউএনএইচসিআর এর এই মুখপাত্র বলেন, “এই দুর্বল শরণার্থীরা আবারও আক্রান্ত হচ্ছে এবং আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।”

সংহিসতার জেরে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থাগুলো শরণার্থী শিবিরগুলোতে বুধবার অস্থায়ীভাবে সেবা কার্যক্রম স্থগিত করে দিলেও বৃহস্পতিবার তা আবার শুরু হয়েছে বলে জানান সাজ্জাদ।

টানা পাঁচ দিনের দফায় দফায় গোলাগুলি-সংঘর্ষে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী বসতি খ্যাত উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী মেগাক্যাম্পের পরিবেশ এখনও থমথমে। এ ঘটনায় আশেপাশের ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া সবাই এখনও নিজেদের ঘরে ফেরেননি বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতারা।

সহিংসতায় কয়েকশ পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন জানিয়ে সাজ্জাদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য কাজ করছে তাঁর সংস্থা। যদিও চলমান অস্থিতিশীলতা তাঁদের সব চেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে।

“ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সেবা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে একটু ব্যাঘাত ঘটেছিল। কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেছে,” বেনারকে বলেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন।

হোতাদের খুঁজছে পুলিশ

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে আলোচনায় আসা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতা মাস্টার মুন্না ও আবু আনাচকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

মুন্না ও আনাসকে কুতুপালং শিবিরের ধারাবাহিক সহিসংসতার ‘মূল নায়ক’ উল্লেখ করে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী তাঁদের ধরতে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।”

শিবিরের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ, আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও র‍্যাবের পাশাপশি সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এখন মাঠে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

“ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃংখলা বাহিনীর টহলও জোরদার করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন অতিরিক্ত আরআরআরসি সামছু-দ্দৌজা নয়ন।

“আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং মুন্না-আনাচসহ সব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি,” মন্তব্য করে সীমান্তের শূন্যরেখায় বসবাসরত শরণার্থী নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “যেসব রোহিঙ্গা অপরাধ করছে তাদের কারণে সব শরণার্থীর বদনাম হচ্ছে।”

এই সন্ত্রাসীরা “ইয়াবা ব্যবসা, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধ” করে সারা বিশ্বে রোহিঙ্গাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ছয় মামলায় গ্রেপ্তার ১৪

কুতুপালং শিবিরে চলতি সপ্তাহের পাঁচ দিনে আট খুন এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন বেনারকে জানান, এর মধ্যে পাঁচটি হত্যা এবং একটি অস্ত্র আইনের মামলা।

“এসব মামলায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে দুইজন অস্ত্র মামলার আসামি,” বলেন গাজী সালাহ উদ্দিন।

তিনি জানান, “বর্তমানে ক্যাম্পের পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক রয়েছে।”

অপহৃত দুই খ্রিস্টান পরিবার

কুতুপালংয়ে পহেলা অক্টোবর রাত থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ চলাকালে দুটি খ্রিস্টান রোহিঙ্গা পরিবারের সাত সদস্য অপহৃত হওয়ার অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।

অপহৃত খ্রিস্টান রোহিঙ্গা আবু তালেবের (৩৬) স্ত্রী লাইলা বেগম (৩০) বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “দুই দিন আগে আমার স্বামীকে সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গেছে। সাথে সাথেই পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু এখনও তাঁর খোঁজ পাইনি। জানি না তিনি বেঁচে আছে কিনা।”

“আমার স্বামীর সঙ্গে চার শিশুসহ আরো ছয় জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদেরও কোনো খবর নেই,” যোগ করেন তিনি।

আরেক খ্রিস্টান রোহিঙ্গা যুবক সাইফুল ইসলাম পিটার বেনারকে বলেন, “কুতুপালং ক্যাম্পে মঙ্গলবার রাতে মারামারি শুরু হওয়ার পর সেখানকার হোসেন আহমদ (২৬) তাঁর পরিবার নিয়ে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পের ফটকের পাশে আশ্রয় নেয়।”

তিনি জানান, বুধবার সকালে সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁদের ধরে ক্যাম্পের পাহাড়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। বিষয়টি ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) ও পুলিশ জানানো হয়েছে।

হোসেনের পরিবারের অপহৃত বাকি সদস্যরা হলেন তাঁর স্ত্রী আনু (২৪), সন্তান জান্নাত আরা (৩), ছুছুমা (১), মরিজান (৮) ও নুর আনকি (৬)।

খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের নিখোঁজের বিষয়ে স্বজনরা থানায় অবহিত করেছেন বলে বেনারকে জানান উখিয়ার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহম্মদ সনজুর মোরশেদ।

তবে “বর্তমান পরিস্থিতির কারণে অনেকেই এদিক-ওদিক চলে গেছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে কারণে কেউ আদতেই নিখোঁজ হয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল।”

“তবু পুলিশ তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে,” বলেন তিনি।

বুধবার রাতে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে শরণার্থী শিবিরের পাচঁটি ঘর পুড়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

এদিকে গত জানুয়ারিতে নিখোঁজ হওয়া খ্রিস্টান রোহিঙ্গা তাহের ও তাঁর পরিবারের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি বলে বেনারকে জানান সাইফুল ইসলাম পিটার।

যৌথ টহল দেবে বিজিবি-বিজিপি

সীমান্ত সুরক্ষায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি যৌথভাবে টহল দেবে। বৃহস্পতিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে দুই বাহিনীর এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঘুমধুম সীমান্তের নোয়াপাড়া মৈত্রী ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির কক্সবাজার অঞ্চলের (অপারেশন অফিসার) লে. কর্ণেল সরকার মাহমুদ মোস্তাফিজুর রহমান এ তথ্য জানান।

কক্সবাজার থেকে প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া ও আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।