অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিশুপল্লি: ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা

প্রাপ্তি রহমান
2017.10.12
ঢাকা
টেকনাফের হোয়াইক্যং পুথিন পাহাড়ে বিজিবির দেওয়া খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। টেকনাফের হোয়াইক্যং পুথিন পাহাড়ে বিজিবির দেওয়া খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। ১১ অক্টোবর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমার থেকে আসা অনাথ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের সুরক্ষা দিতে সরকারের শিশুপল্লি তৈরির পরিকল্পনার সাথে একমত নন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন অনাত্মীয় পরিবেশে শিশুদের রাখা হলে তাতে অসহায় শিশুদের ঝুঁকির পরিমাণ আরো বাড়বে।

“আমরা এই শিশুদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করার কথা ভাবছি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের জন্য শিশুপল্লি আছে। সে রকম কিছু করা যায় কি না, সেটি বিবেচনা করা হচ্ছে,” বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হাবিবুল কবির।

তবে শরণার্থী শিশুদের বিচ্ছিন্নভাবে রাখলে তাদের ঝুঁকির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গওহর নাঈম ওয়ারা।

তিনি বেনারকে বলেন, “শরণার্থী শিশুরা এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে থাকে, যখন সে পরিবার বিচ্ছিন্ন তখন তার জন্য ঝুঁকিটা হয় আরও বেশি।”

এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শূন্য থেকে সাত বছর বয়সের অনাথ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন রোহিঙ্গা শিশুদের এক স্থানে এবং ৮ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের আরেক জায়গায় রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে তাদের পরিচর্যা করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।

তবে শিশুপল্লি কোনো বিবেচনাতেই ‘ভালো বিকল্প নয়’ মন্তব্য শিশুপল্লি পরিচালনায় সকারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গওহর নাঈম ওয়ারা।

তিনি বলেন, “দেশে অনাথ শিশুদের জন্য যেসব শিশুপল্লি আছে, সেগুলো কি শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে পেরেছে? গেল কয়েক বছরে শিশুপল্লির ভেতর শিশুদের পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে বিদ্রোহ করার কথা শোনা গেছে। তাই নতুন করে শিশুপল্লি তৈরি কতটা যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখা দরকার।”

“এ ধরনের শিশু পাচারের শিকার হতে পারে, ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, বিক্রি হয়ে যেতে পারে, এমনকি রোহিঙ্গা শিশুদের দিয়ে মাদক আনা নেওয়ার কাজ করানোরও আশঙ্কা থাকে। তাই শিশুপল্লি কোনো বিবেচনাতেই ভালো বিকল্প নয়,” জানান গওহর নাঈম ওয়ারা।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেবে, এখন পর্যন্ত পরিবারবিচ্ছিন্ন ১০ হাজার ২৯৯ টি শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় ২৫ আগস্ট থেকে বুধবার পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের এসেছে বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজি। এদের মধ্যে তিন লাখের বেশি শিশু।

এই শিশুদের মধ্যে মা–বাবা হারিয়ে আসা শিশুদের চিহ্নিত করে স্মার্ট কার্ড বিতরণ শুরু হয়েছে বলে গত মাসের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন সমাজকল্যাণ সচিব জিল্লার রহমান।

“গত দুদিন ধরে নতুন করে বড় সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে দেখেছি আমরা। আমাদের আশঙ্কা পরিবারবিচ্ছিন্ন শিশুর সংখ্যা আরও বাড়বে,” বেনারকে জানান মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহীদুল ইসলাম।

ঠিক কবে নাগাদ এই শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সেবার ব্যবস্থা করা হবে—জানতে চাইলে শহীদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “খুব দ্রুত এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য ১০ অক্টোবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করা হচ্ছে।”

“সরকার যে দুই হাজার একর ভূমি শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ করেছে, সেখান থেকে ২০০ একর জমি চাওয়া হয়েছে শিশু পল্লির জন্য। এই জমি সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ঘুরে দেখেছেন, বলেন তিনি।

ইউনিসেফের ভাবনা ভিন্ন

শিশুপল্লি তৈরির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট শাকিল ফয়জুল্লাহ জানান, এখন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের সহায়তা চাওয়া হয়নি। পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে ইউনিসেফের চিন্তাভাবনাও কিছুটা আলাদা বলে জানান তিনি।

“দেখুন, আমরা মনে করি শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো তার পরিবার। যেসব শিশু বাবা-মা হারিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে নিকটাত্মীয়কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। গত অক্টোবরের পর এমন বেশ কিছু শিশুকে আমরা নিকটাত্মীয়দের পরিবারে যুক্ত করতে পেরেছিলাম। নিকটাত্মীয় পাওয়া না গেলে একটু দূরের আত্মীয়র কাছ থেকেও এই সহায়তা চাওয়া হয়,” শাকিল ফয়জুল্লাহ বেনারকে বলেন।

তিনি আরও জানান, একটি পরিবারে পুনর্বাসনের পর পরের বেশ কয়েক বছর শিশুরা কেমন থাকল তার খোঁজখবর নেয় ইউনিসেফ।

এতিম শিশুদের কথা

বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টার দিকে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে ত্রাণের লাইনের পাশে দাঁড়িয়েছিল দুই শিশু মো. আইয়ুব (১০) ও মো. সোয়েব (৮)। তারা দুই ভাই জানায়, তারা সবাইকে হারিয়েছে।

মিয়ানমার মংডুর বড় গজবিল গ্রামে তাদের বাড়ি। গত ২০ দিন আগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামে এসে বাবা দিলু মিয়া, মা নুর বেগম ও বড় ভাই মো. আজিমকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের আর চোখে দেখেনি। তারা দুই ভাই অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পালিয়ে এসে লেদা ক্যাম্পে একই গ্রামের নুর হাকিম নামে আরেক রোহিঙ্গার পলিথিনের ছাউনি ঘরে আশ্রয় নেয়।

“আমরা জানি না আমাদের মা–বাবা ও ভাই কোথায়,” বেনারকে জানায় আইয়ুব।

গত দুই দিন আগে নৌকা করে নাফ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে সাগরে প্রাণ হারান মিয়ানমার হাসসুরাতা গ্রামের ইয়াকুব আলী ও মরিয়াম বেগম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় তাদের দুই সন্তান ইমাম হোসেন (১২) ও নুর হোসেন (১৫)। তাঁরা এখন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রাস্তার পাশে চাচা মো. রশিদের আশ্রয়ে থাকে।

ইমাম হোসেন বেনারকে জানায়, মিয়ানমার সেনারা তার বড় ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে। বড় বোনকে ধরে নিয়ে গেছে।

আমাকে কেউ খেতে দেয় না

পাঁচ বছরের আবদুর রহমান তার বন্ধুর সঙ্গে যখন খেলছিল, তখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে হামলা চালায়। বাবা–মা দুজনকেই হারায় সে। তারপর আত্মীয়–স্বজনের সঙ্গে সেও প্রাণে বাঁচতে চলে আসে বাংলাদেশে।

“আমিও অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসি। কেউ আমাকে খাবার দিচ্ছে না। আমার খুব খিদে পেয়েছে,” ত্রাণ সংগ্রহের সারিতে দাঁড়িয়ে অনাথ রহমান বলছিল বেনারনিউজকে।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।