রোহিঙ্গা ইস্যু: মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানাবে না ইইউ
2017.10.16

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি “চরমভাবে মারাত্মক” উল্লেখ করে সেখানকার সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ইউরোপীয় কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স সোমবার বার্মার সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমুহে প্রবেশের আমন্ত্রণ না জানাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে সফররত মালয়েশীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর মহাপরিচালক উইলিয়াম ল্যাসি সুইং সোমবার পৃথকভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছেন।
“নিরাপত্তা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের কথা বিবেচনা করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সামরিক বাহিনীর অন্যান্য উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের তাদের দেশে স্বাগত জানানো থেকে বিরত থাকবে এবং বার্মার সাথে সকল ব্যবহারিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পর্য়ালোচনা করবে,” বলা হয় ইউরোপীয় কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স এর সিদ্ধান্তে।
ইইউ আরো নিশ্চিত করছে, “অভ্যন্তরীণ নিপীড়নের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন আশঙ্কার কারণে বার্মায় অস্ত্র ও সামরিক উপকরণ সরবরাহের ওপর অবরোধের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।”
গৃহীত সিদ্ধান্তে ইউরোপীয় কাউন্সিল বলছে, রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার পরিস্থিতি “চরমভাবে মারাত্মক”। সেখান থেকে নির্বিচার গুলিবর্ষণ, স্থল মাইন স্থাপন এবং যৌন ও লিঙ্গ সহিংসতাসহ অব্যাহত অগ্নিসংযোগ ও মারাত্নক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর আসছে।
এতে বলা হয়, “এত কম সময়ে এত সংখ্যক মানুষের বাস্তচ্যুত হওয়া প্রমাণ করে যে এটি একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পরিকল্পিত উপায়ে বহিষ্কার করার ব্যবস্থা।”
একইসঙ্গে, মানবিক সাহায্য প্রদান নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ, রেডক্রস ও অন্যন্য এনজিওদের অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কাউন্সিল।
“এছাড়াও, ইইউ শরণর্থীদের তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে প্রত্যাবাসনসহ সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে, প্রতিবেশিসুলভ সম্পর্কের ভিত্তিতে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছে,” বলা হয় সিদ্ধান্তে।
“কঠিন পরিস্থিতিতে” গঠনমুলক ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয় সিদ্ধান্তটিতে।
বাংলাদেশের প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থন
সফররত মালয়েশীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সোমবার কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশের প্রতি তিনি এই সমর্থন ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে রাজি করাতে মালয়েশিয়া অন্যান্য আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহকে সাথে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
“রোহিঙ্গাদরে প্রতি যে মানবতা বাংলাদেশ দেখিয়েছে বিশ্বে সেটি একটি উদাহরণ,” বলেন হামিদি।
রোববার বাংলাদেশ সফরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর সাথে দেখা করে হামিদি বলেন, মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ফিল্ড হাসপতাল স্থাপন করবে। অচিরেই এই হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হবে বলে হামিদি জানান।
রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকাডুবি, ১১ লাশ উদ্ধার
রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গা বোঝাই আরও একটি নৌকা সোমবার সকালে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় ডুবে গেছে। এতে ১১ জনের লাশ উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড সদস্যরা। এর মধ্যে পাঁচ শিশু ও ছয় নারী রয়েছে। এ ঘটনায় জীবিত ২১ জনকে উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ রয়েছে অনেকে।
সোমবার সকাল ৮টায় সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া বেড়িবাধঁ ভাঙার কাছাকাছি সাগর থেকে এ লাশগুলো উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম শরীফ।
পাঁচ সন্তান নিয়ে ওঠা ওই নৌকার যাত্রী নূর নাহার বেনারকে বলেন, “নৌকায় প্রায় ৬৫ জনের মতো রোহিঙ্গা ছিল। এদের মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। আমার সন্তানদের এখনও সন্ধান পাইনি।”
তাঁর স্বামীকে ২০ দিন আগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করেছে বলে জানান নুর নাহার।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মাইন উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, নিখোঁজদের সন্ধান করা হচ্ছে।
এ নিয়ে গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
আইওএম প্রধানের সফর
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর মহাপরিচালক উইলিয়াম ল্যাসি সুইং বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো।
সোমবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও নাইক্ষংছড়ির ঘুমধুম রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন। এসময় তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লক ঘুরে দেখেন এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দুর্দশার কথা শোনেন। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় ২৫ আগস্ট থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের এসেছে বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজি।
বন্য হাতির আক্রমণে ৪ রোহিঙ্গা নিহত
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড়ে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবিরে বন্য হাতির আক্রমণে মা-ছেলেসহ চার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। শনিবার দুপুরে বালুখালী-১ রোহিঙ্গা শিবিরের ডি-ব্লকে এ ঘটনা ঘটে বলে জানায় পুলিশ।
নিহতদের তিনজন ৭ থেকে ১১ বছরের ছেলে শিশু ও অন্যজন ৩৫ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা নারী।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, “নিহতরা মিয়ানমারের নাগরিক, মাত্র দুদিন আগে তারা এই শিবিরে আশ্রয় নেয় বলে জানা গেছে। তবে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।”
এ বিষয়ে উখিয়ার থাইংখালী বনবিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, বালুখালীর এই রোহিঙ্গা ব্লকটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় বন্য হাতির চলাচল রয়েছে। বন ধ্বংস হওয়ায় বন্য হাতির দল খাদ্যের সন্ধানে প্রায়ই লোকালয়ে নেমে আসছে বলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।”
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর একই শিবিরের মধুরছড়া পাহাড়ে বন্য হাতির আক্রমণে আরো দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি ও কুয়ালালামপুর থেকে হাতা ওয়াহারি।