সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের স্রোত

জেসমিন পাপড়ি ও তুষার তুহিন
2017.10.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
জীবন বাঁচাতে নাফ নদী পেরিয়ে আঞ্জুমান পাড়া সীমান্তে জড়ো হয়েছেন হাজারো রোহিঙ্গা। জীবন বাঁচাতে নাফ নদী পেরিয়ে আঞ্জুমান পাড়া সীমান্তে জড়ো হয়েছেন হাজারো রোহিঙ্গা। ১৬ অক্টোবর ২০১৭।
তুষার তুহিন/বেনারনিউজ

নানা কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হয়নি মিয়ানমার। ফলে এখনো দেশটির রাখাইন রাজ্যের এই সংখ্যালঘু মুসলিমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

গত রোববার থেকে অন্তত ১৫ হাজার নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এদিকে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।

এছাড়া গত তিন দিনে বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তের উখিয়া উপজেলার আঞ্জুমান উত্তর পাড়ার নাফ নদীর বেড়ি বাঁধের ওপর বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে বলে জানা গেছে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী সাতটি পয়েন্ট দিয়ে পায়ে হেঁটে তারা এখানে পৌঁছেছে। সেখানে তাদের মানবিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।

পাশাপাশি, আরও অসংখ্য রোহিঙ্গা এপারে প্রবেশ করতে ওপারের কয়েকটি পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় গত তিন দিনে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তারা সেখানেই নাফ নদীর তীরে বিজিবিসহ স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। দ্রুত তাদের উখিয়ার কুতুপালংয়ে নিয়ে আসা হবে।”

কক্সবাজার বিজিবি’র সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আনিসুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিজিবি’র জিম্মায় প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে উখিয়া সীমান্তে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।”

খাদ্য সংকটই কারণ

মূলত খাদ্যের অভাব, কর্মহীনতা, ঘরে বন্দী করে রাখাসহ মৌলিক চাহিদার অপূর্ণতার কারণেই তারা পালিয়ে আসছেন বলে দাবি রোহিঙ্গাদের। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশির ভাগ বুথিডং থানার মগনামা, কোয়াইনডং, জাদিপাড়া, লাওয়াডং গ্রামের বাসিন্দা।

আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে পালিয়ে আসা রাখাইনের বুথিডং থানার কোয়াইডং গ্রামের মোঃ ইসলাম (৪৫) বেনারকে বলেন, “রাখাইনের সহিংসতার পর থেকে স্থানীয় গ্রাম্য বাজার বন্ধ রয়েছে। যারা গ্রামে রয়েছে তারা কোনো কাজ-কর্ম করতে পারছে না। বাড়িতে খাবার নেই।”

“পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে অনেক দিন ধরে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছি। মগ-সেনারা কোথাও দেখলে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে আছি। প্রতি মুহূর্ত আতঙ্ক আর প্রাণের ভয়। তাই এপারে আসতে বাধ্য হয়েছি,” বলেন তিনি।

“জ্বালাও পোড়া বন্ধ করে রাখাইনের সেনারা এখন কৃত্রিমভাবে খাদ্য সংকট তৈরি করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসতে বাধ্য করছে,” বেনারকে বলেন পালিয়ে আসা আরেক রোহিঙ্গা আব্দুর রশিদ।

তিনি আরও বলেন, “মিয়ানামারের কুয়িন্সাবং, চাকমা কাটা ও তমারবিলের পাহাড়ি সীমান্তে আরও প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।”

এদিকে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক মেজর আশিকুর রহমান বেনারকে জানান, “বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা ওপারে রোহিঙ্গাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাঁদের ডেকে আনছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

আবারও জ্বলছে রাখাইন, ইউএনএইচসিআরের উদ্বেগ

এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও রাখাইনের বিভিন্ন গ্রাম পোড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী, এমনকি স্থানীয় লোকজনের সম্মিলিত নিপীড়নের মুখে এসব গ্রামের রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

মঙ্গলবার জেনেভা থেকে দেওয়া বিবৃতিতে আবারও বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা আগমনে মানবিক সংকট আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করেছে সংস্থাটি।

গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার-সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছেন ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা। জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “নতুন আসা রোহিঙ্গাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এদের অধিকাংশই রাখাইনের বুথিডং থেকে এসেছেন। অন্তত পাঁচ-ছয় দিন পাহাড়-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশে পৌঁছেছে।”

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে আরও গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ায় তারা প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসছেন বলেও তিনি জানান।

এদিকে স্যাটালাইটে পাওয়া নতুন তথ্য বিশ্লেষণ করে ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ২৮৮টি গ্রাম সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

আরও এক লাশ উদ্ধার

সোমবার সকালে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় আরও এক কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড। মঙ্গলবার বেলা ১২ টার দিকে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফ নদীর পশ্চিমপাড়া পয়েন্ট থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সী ওই কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম শরীফ জানান, “মঙ্গলবার সকালে আরও এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।”

প্রসঙ্গত, গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

নিরাপদ অঞ্চলের প্রস্তাব দেবে মালয়েশিয়া

এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ নিরাপদ অঞ্চল গঠন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব দেবে মালয়েশিয়া।

সোমবার বাংলাদেশ সফররত মালয়েশীয় উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে এই প্রতিশ্রুতি দেন বলে জানায় মালয়েশিয় গণমাধ্যম স্টার অনলাইন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।