হঠাৎ করেই রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়ে গেছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার
2020.10.20
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে চলতি বছর হঠাৎ করেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
পুলিশের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী শিবির এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র, গত বছরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ২৬টি।
শিবির এলাকায় এত অস্ত্র কীভাবে আসে তা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মাদক আর অস্ত্র একই সূত্রে গাঁথা।
“হঠাৎ করেই ক্যাম্পগুলোয় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এখানে কীভাবে এত অস্ত্র এলো, তা উদ্ঘাটনের জন্য আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. হেমায়েতুল ইসলাম।
শরণার্থী শিবিরে এত আগ্নেয়াস্ত্র কোথা থেকে আসছে তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে জানিয়ে র্যাব-১৫ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদি হাসান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মাদক আর অস্ত্র একই সূত্রে গাঁথা। মাদক পাচারের সুবিধার্থে অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।”
চলতি অক্টোবরে কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্ত এবং উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরসহ পাহাড়ি এলাকা থেকে ২৫-৩০ দেশি-বিদেশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. রফিকুল ইসলাম।
“এ সময় অর্ধশতাধিক অস্ত্রধারীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়াও উদ্ধার করা হয়েছে প্রচুর ধারালো অস্ত্র,” বলেন রফিকুল ইসলাম।
অক্টোবরের শুরুতে উখিয়ার কুতুপালংয়ে মাস্টার মুন্না গ্রুপ ও আবু আনাচ বাহিনী নামের দুটি প্রতিপক্ষ রোহিঙ্গা গ্রুপের ধারাবাহিক সংঘর্ষে পাঁচ দিনে আটজন নিহত হওয়ার পর অভিযান জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
ওই সংঘর্ষে যুক্ত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজি সালাহ উদ্দিন।
অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান (সিপিএস) বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কাদের মিয়ার মতে, “বিভিন্ন এলাকার সীমান্ত দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে অস্ত্র আসে। তারপর বিভিন্ন কৌশলে সেগুলো পৌঁছে যায় ক্যাম্পে।”
“মিয়ানমার থেকেই মাদকের সাথে অস্ত্র আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কারণ তারা এখানকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব এইচএম নজরুল ইসলাম।
তবে “মিয়ানমার থেকে অস্ত্র আসে কিনা তা জানা নেই,” বলে কুতুপালংয়ের সহিংসতার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন।
সামরিক পোশাকে সশস্ত্র রোহিঙ্গা
শরণার্থীশিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সামরিক পোশাক পরে এবং অস্ত্র হাতে ছবি প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কুতুপালংয়ে দুটি রোহিঙ্গা প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর ধারাবাহিক সংঘর্ষের পরপরই এ জাতীয় ছবি-ভিডিও প্রকাশ শুরু হয়, যাতে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
যেসব রোহিঙ্গা এমন ছবি ও ভিডিও তুলে প্রচার করেছেন তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে বেনারকে জানান এপিবিএন অধিনায়ক হেমায়েতুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে এমন একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
অস্ত্র হাতে ছবি প্রচারের পর গত শুক্রবার টেকনাফের নয়াপাড়া আটক হওয়া সৈয়দুল আমিন (২৫) উখিয়ার বালুখালী শিবিরের হামিদ হোসেনের ছেলে।
আমিন মাস্টার মুন্না গ্রুপের সদস্য বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
আমিনের ওই ছবিটি বেনারের কাছেও এসেছে। এতে দেখা যায়, সামরিক পোশাক পরা আমিনের গলার কাছে একটি ওয়াকিটকি ঝুলছে, আর দুই হাতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন আমিন।
তাঁকে জোরপূর্বক এই ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমিন পুলিশকে জানালেও, কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁর এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।
“তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে প্রকৃত তথ্য বের করা হবে,” জানিয়ে অধিনায়ক হেমায়েতুল বলেন, “এভাবে হঠাৎ করে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র ছবি ও ভিডিও প্রচারের পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের মদদ থাকতে পারে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর একটি যৌথ দল কাজ করছে।”
“এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। আন্তর্জাতিক, দেশি বা রোহিঙ্গাদের ভেতরের একটি পক্ষ শরণার্থীদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাজনিত অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চাচ্ছে,” বলেন আব্দুল কাদের মিয়া।
কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আইয়ুব বেনারকে বলেন, “সশস্ত্র এমন ছবি প্রকাশের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কের মধ্যে আছে। কারণ তাঁদের ধারণা, এর পেছনে মিয়ানমারের হাত থাকতে পারে।”
সামরিক পোশাক পরে প্রচার করা ভিডিওগুলোতে একাধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তাঁরা ‘আল-ইয়াকিনের’ (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার পুরোনো নাম) বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। মিয়ানমারের রাখাইনে তারা (আরসা) সাধারণ রোহিঙ্গাদের অত্যাচার করেছে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতেও একই তৎপরতা শুরু হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বরাবরই বলে আসছেন, বাংলাদেশে আরসার কোনো অস্তিত্ব নেই। শরণার্থীশিবিরের অপরাধীরা আতঙ্ক তৈরির জন্য আরসার নাম ব্যবহার করে।
“কুতুপালংয়ের ঘটনার সাথে আরসার কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা পাইনি আমরা, বেনারকে বলেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজি সালাহ উদ্দিন।