রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.22
ঢাকা
201022-BD-BU-US-donors-rohingya_1000.jpeg উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ২৭ জানুয়ারি ২০১৮।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সহায়তার জন্য আয়োজিত দাতাগোষ্ঠীর সম্মেলনে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের আশ্বাস মিলেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই ঘোষণা দিয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার।

সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১১৩ মিলিয়ন ও যুক্তরাজ্য ৬১ মিলিয়ন ডলার ছাড়াও ফিলিপাইন, ফিনল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ অনুদানের ঘোষণা দেয়।

এর ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ও মিয়ানমারে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা পরিচালনা ছাড়াও ঘাটতি বাজেট মেটানো সম্ভব হবে।

২০২০ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন (একশো কোটি) ডলারের সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের কম সহায়তা পাওয়া যায়।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ভার্চুয়াল সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সদস্য রাষ্ট্র, আসিয়ান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বোঝা আর টানতে সক্ষম নয়। রোহিঙ্গাদের তাঁদের দেশে ফিরে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য খরচের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।”

সম্মেলন শেষে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি বলেন, “মানবিক সাহায্য প্রদানের খুব দৃঢ় অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ৫৯৭ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা এসেছে।”

তিনি বলেন, “আমরা যে পর্যন্ত অগ্রগতি অর্জন করেছি সেটি হারানো ঠিক হবে না এবং শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কাজ করে যেতে হবে।”

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাবে, পুরো এশিয়া অঞ্চলে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থী। বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে আট লক্ষ ৬০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। মালয়েশিয়ায় এক লাখ দু্ই হাজার ও ভারতে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার বাস্তচ্যুত হয়ে রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় আছেন।

এর আগে ২০১৭ সালে আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য এ পর্যন্ত দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান করে বিভিন্ন দাতা দেশ।

২০২০ সালে দুই দফায় রোহিঙ্গাদের জন্য এক বিলিয়ন ডলার সাহায্যের আবেদন করে ইউএনএইচসিআর। তবে অর্ধেকের কম সাহায্য পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গারা রাখাইন ফিরে যাক

রোহিঙ্গাদের অর্থ সহায়তার জন্য আয়োজিত সম্মেলনের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা অনুবিভাগের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এই সম্মেলনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক সাহায্য মিলেছে, যা তাদের জন্য ব্যয় হবে; বাংলাদেশ এই অর্থের সুবিধাভোগী নয়।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য যে আন্তর্জাতিক সহায়তা মাঝেমধ্যে দেয়া হয় তা খুবই অপ্রতুল।”

মহাপরিচালক দেলোয়ার বলেন, “জীবিকার সুযোগ ছাড়াও স্থানীয় জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কারণে চরম ক্ষতির শিকার হয়েছে। তাদের জমিজমা দখল হয়ে গেছে, রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁদের গাছ কেটে নেয়া হয়েছে। তাঁদের ক্ষতির মধ্যে অনেকগুলো অপূরণীয়। রোহিঙ্গাদের কারণে এই এলাকায় পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে যা কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন।”

তিনি বলেন, “অর্থের সংস্থার আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গারা তাদের আবাসস্থল রাখাইনে ফিরে যাক। আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য ভূমিকা ও চাপ রাখুক।”

বান্দরবানের ঘুমধুম কোনারপাড়ার নো-ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। পাশাপাশি তারা আমাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করছে। এ জন্য এ দেশের সরকারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু এটাই বাস্তবতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশেরর পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভরনপোষণের খরচ বহন করা সম্ভব নয়।”

“রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে আন্তজার্তিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সহযোগিতা আছে বলেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। তাই তাদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ,” যোগ করেন দিল মোহাম্মদ।

এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, “আমরা আশা করছি, এই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে বাংলাদেশ এবং বিশ্ববাসীর প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”

বর্তমান সরকার এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী।

“উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগোষ্ঠিও রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে যার যা আছে, তা নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু বর্তমানে রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।”

হামিদুল হক আরও বলেন, “এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার থাকা- খাওয়া, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যয়ভার মেটানো এত সহজ নয়। জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে।”

“রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের উচিত স্থানীয়দের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ানো,” বলেন তিনি।

কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসু দ্দৌজা বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া একটি দেশের পক্ষে মানবিকতার এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন।

“তাই আমরা আশা করব শুরু থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে, সেভাবে শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে,” বলেন তিনি।

চিকিৎসা নেবার পর উখিয়ায় মালয়েশিয়ার ফিল্ড হাসাপাতালের সামনে বসে আছেন একজন আহত রোহিঙ্গা। ২৭ জানুয়ারি ২০১৮।
চিকিৎসা নেবার পর উখিয়ায় মালয়েশিয়ার ফিল্ড হাসাপাতালের সামনে বসে আছেন একজন আহত রোহিঙ্গা। ২৭ জানুয়ারি ২০১৮।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

মালয়েশিয়ার ফিল্ড হাসপাতাল বন্ধ

২০১৭ সালে উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য স্থাপিত মালয়েশিয়ার ফিল্ড হাসাপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই হাসপাতালে ২০ জন মালয়েশিয়ান ডাক্তারসহ ৫৬ জন কর্মী কাজ করতেন।

হাসপাতালটি ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের কর্মীরা করোনাভাইরাস সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এই হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে বলে জানানো হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

মালয়েশিয়া সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই হাসপাতাল স্থাপনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রতিদিন এই হাসপাতাল আট হাজার ৭৬৩ জন রোগীর চিকিৎসা করত। তাদের সেবার কারণে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৯০।

যদিও কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডাঃ আবু তোহা এম আর এইচ ভূঁইয়া বেনারকে জানান, “হাসপাতালটি এখন বন্ধ আছে। তবে এটি কেন বন্ধ করা হয়েছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। আমরা আশা করছি, করোনা পরিস্থিতি শেষ হওয়ার পর হাসপাতালটি আবার চালু হবে।”

নির্যাতনের নতুন প্রতিবেদন

মিয়ানমার সেনাদের হাতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত রোহিঙ্গা নারীদের সেবা দেয়া ডাক্তার ও নার্সদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সেনারা তাঁদের গণধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করেছে। তাঁদের ওপর যৌন সহিংসতা ঘটিয়েছে।

রোহিঙ্গা নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই নির্যাতনের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।