স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর: মিয়ানমার যৌথ সিদ্ধান্ত বদলে ফেলায় বিবৃতি সই করেনি বাংলাদেশ
2017.10.27

সম্প্রতি বাংলাদেশর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনো যৌথ বিবৃতি তৈরি করা সম্ভব হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন প্রতিনিধিদলের নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
বাংলাদেশকে না জানিয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হওয়া কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি বাদ দিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিবৃতি প্রকাশ করায় বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতিতে সই করেনি বলে জানান তিনি।
“যৌথ ইশতেহারের ১০ দফায় কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে দেখলাম ওই অংশ বাদ দিয়ে তারা একতরফাভাবে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাই আমরা বিবৃতিতে সই করিনি,” শুক্রবার বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গত ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল মিয়ানমার যায়। দলটি ফিরেছে ২৫ অক্টোবর।
অং সান সুচির সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে করণীয় ঠিক করতে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিশনের প্রতিবেদন গত ২৪ আগস্ট সু চির কাছে হস্তান্তর করেন আনান।
ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদানসহ দেশটির অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় অংশ নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বারবার যৌথ বিবৃতিটি ঘষামাজা করেছে। তারা কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের অংশটি বাদ দিয়েছে। তা ছাড়া তারা যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে তাতে অনেক ভাষাগত ভুল রয়েছে। তারা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে উল্লেখ করেছে।”
“আমরা বলেছি সারা বিশ্বে ৩৫- ৩৬ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তারা সবাই কি বাঙালি? আমরা পরিষ্কার বলেছি রোহিঙ্গারা বাঙালি নয়, তারা রাখাইনের অধিবাসী,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
নেতিবাচক ছিলেন না সু চি
সু চির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তিনি আমাদের কোনো নেতিবাচক কথা বলেননি। আমরা খুব খোলামেলা আলোচনা করেছি। আমি তাঁকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করি।”
“তিনি (সু চি) আমাদের বলেছেন তাঁর সরকার কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে,” জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মন্ত্রী আরও বলেন, “আলোচনার এক পর্যায়ে সু চি বলেন, যারা বাংলাদেশে পালিয়ে যায় তারা আর ফিরে আসতে চায় না। তোমরা তাদের ফিরে আসতে উৎসাহিত করো। আমি বলেছি ফিরে আসার পরিবেশ না থাকলে কীভাবে আসবে?”
আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া কিছু করবে না মিয়ানমার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে বাংলাদেশ শুরুর দিকে আশাবাদী হলেও ফিরে আসার পর তাঁর হতাশা থেকে এটা স্পষ্ট যে সেই সফরে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য আসেনি।
“মিয়ানমার কঠিন দেশ,” মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত না রাখলে মিয়ানমার কিছুই করবে না।”
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সাবেক কূটনীতিক ও গবেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনা মহসিন বেনারকে বলেন, “আমি মিয়ানমারের কথা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল দেখি না। তারা প্রেস কনফারেন্স করে বলছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো প্রতিফলন নেই।”
“তারা যদি একতরফাভাবে যৌথ ইশতেহার থেকে কোনো অংশ বাদ দিয়ে থাকে তবে তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের গ্রস ভায়োলেশন,” বেনারকে বলেন আমিনা মহসিন।
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, জাতিসংঘ ছাড়া দ্বি-পাক্ষিকভাবে শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমম্যার সমাধান করা কঠিন হবে। তাই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।”
সরাসরি কোনো ফলাফল না আসলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন পেশাদার কূটনীতিক ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমি এই সফরের একটি ইতিবাচক দিক দেখি। তা হলো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে নিয়মিত আলোচনার মধ্যে আছে। মিয়ানমার বিষয়টি দীর্ঘায়িত করতে চাইবে। কিন্তু আমাদের কাজ হবে তাদের আলোচনায় সম্পৃক্ত রাখা।”
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত
গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর ঢাকার কমিউনিকেশন অফিসার জোসেফ ত্রিপুরা শুক্রবার বেনারকে বলেন, “সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ছয় লাখ চার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।”
“এই অনুপ্রবেশ এখনো অব্যাহত আছে। তবে সংখ্যা কমে এসেছে”, জানান তিনি।
আমরা গভীরভাবে মর্মাহত: এইচআরসি
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিল (এইচআরসি) এর বিষেশজ্ঞ পর্যায়ের তিন সদস্য বিশিষ্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনের তদন্ত শেষ করেছে বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানানো হয়।
“পরিদর্শন শেষে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত,” বিবিৃতিতে বলেন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও মানবাধিকার কর্মী মারজুকি দারুসমান।
“আমরা রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বিভিন্ন মানুষের বিবরণ শুনেছি। তারা সকলেই হাজার হাজার মানুষের ওপর চালানো একই ধরনের পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছে,” বিবৃতিতে বলেন দারুসমান।
বিশেষজ্ঞ দলটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এসে বাংলাদেশের কুতুপালং, নয়াপাড়া ও বালুখালি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এছাড়া বাংলাদেশি কর্মকর্তা, ত্রাণ সংস্থা ও বিদেশি কূটনীতিকদের সাথেও আলোচনা করে।
এই তদন্ত দলটি রাখাইন রাজ্যে অনুসন্ধান চালানোর জন্য সেখানে যাবার অনুমতি চাইলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনো অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হাইংকে টেলিফোন করেছেন বলে পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতির বরাত দিয়ে জানিয়েছে একাধিক বার্তা সংস্থা।
টিলারসন রোহিঙ্গাদের নিরাপদে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সহযোগিতা চেয়েছেন। এর আগে টিলারসন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেন।
গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের কথা ভাবছে। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনারেলদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ ও সামরিক অবরোধ আরোপ করে।