রোহিঙ্গা সংকট: হুমকির মুখে কক্সবাজারের পরিবেশ
2017.10.30
কক্সবাজার

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নজিরবিহীন অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের পর্যটন জেলা কক্সবাজারকে মারাত্মক পরিবেশগত হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমানে এ জেলার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। কক্সবাজার দক্ষিণের বন কর্মকর্তা আলী কবির বেনারকে জানান, গত দুই মাসে নতুন আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের প্রায় এক হাজার হেক্টরের সাতটি সংরক্ষিত বন ধ্বংস করেছে।
“ইতিমধ্যে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালীর ঢালা, বাঘগোনা ও তানজিমারঘোনা এবং টেকনাফের পুটবনিয়া ও কেরনতলীর সংরক্ষিত পাহাড় উজাড় করেছে। নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়,” জানান ওই কর্মকর্তা।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার ঘটনার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে দমন-পীড়ন অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকার করে না। বরং প্রায়ই তাদের বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে উল্লেখ করে।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক সহিংসতার আগে থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে চার লাখ রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। নতুন করে অনুপ্রবেশের ফলে এখন উখিয়া ও টেকনাফের ১৫টি শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।
আলী কবির বলেন, “রোহিঙ্গারা উখিয়ার ১ হাজার ৬২৫ একর বনভূমি এবং টেকনাফের ৮৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে বসবাস করছে। তাদের ঘরবাড়ি তৈরিতেও প্রায় ১০ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের জ্বালানি হিসেবে প্রতিদিন শত শত গাছ পোড়ানো হচ্ছে।”
গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের কারণে ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। শরণার্থীদের গাছ কাটা থেকে বিরত রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আলী কবির বেনারকে বলেন, “তিনজন বন কর্মকর্তা গাছ কাটার বিষয়ে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করতে গেলে কয়েকজন রোহিঙ্গা তিন কর্মকর্তার ওপর আক্রমণ চালায়।” তিনি আরও বলেন, “এ পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। যদিও সেটা সময়ের ব্যাপার। তার আগ পর্যন্ত আমাদের কিছুই করার নেই। তারা চলে গেলে আমরা আবার নতুন করে গাছ লাগানোর কাজ শুরু করতে পারব।”
এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফ-উল-আসরাব। তিনি বেনারকে বলেন, “যদি আমরা সত্যিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তবে যত দ্রুত সম্ভব শরণার্থীদের অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।”
জলবায়ু পরিবর্তন
স্থানীয় পরিবেশ কর্মী বিশ্বজিত সেন বেনারকে বলেন, “জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যাপক ব্যবহারে কক্সবাজার জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রায়ই চরম বৃষ্টিপাত বা চরম খরা দেখা দেয়। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জন্য দুইশর বেশি পাহাড়ের গাছ কেটে বসবাসযোগ্য করা হয়েছে। ফলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাখাইন রাজ্য থেকে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অবাধে বন আর পাহাড় কেটে ঝুপড়ি তুলে আশ্রয় নিয়েছে। গত মাসে রাখাইন থেকে পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন আব্দুর শাকুর (৫০)। বালুখালির একটি পাহাড়ে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে তৈরি তার ঘরটি নির্মাণের জন্য অনেক গাছই কাটতে হয়েছিল।
শাকুর বেনারকে বলেন, “আপনি কি মনে করেন সেনাবাহিনী (মিয়ানমারের) যখন আমাদের গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তখন তারা গাছের বিষয়ে চিন্তিত ছিল? মানুষ হত্যা করা পাপ, সমগ্র গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা অন্যায়। গাছ কাটা কী এত খারাপ? এখানে সবাই এটা করছে।”
এ দিকে বন উজাড় করে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কক্সবাজার এলাকার বন্য প্রাণীর আবাস, ঘটছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। উখিয়ায় পাহাড়ে গড়ে ওঠা বালুখালি রোহিঙ্গা শিবিরে বন্য হাতির আক্রমণে গত ১৪ অক্টোবর শিশুসহ চারজন এবং ১৮ সেপ্টেম্বর দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে উখিয়ার থাইংখালী বনবিভাগের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, “বালুখালির এই রোহিঙ্গা ব্লকটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে গড়ে উঠেছে। এ সব এলাকায় বন্য হাতির চলাচল রয়েছে। বন ধ্বংস হওয়ায় বন্য হাতির দল খাবারের সন্ধানে প্রায়ই লোকালয়ে নেমে আসছে বলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।”