সীমান্তে শাক কুড়াতে গিয়ে মিয়ানমারের মাইন বিস্ফোরণে রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু
2020.10.30
কক্সবাজার ও ঢাকা

“সকালে আমরা কয়েকজন মিলে শাক-সবজি কুড়াতে আর মাছ ধরতে সীমান্তে গিয়েছিলাম। এক সময় রাস্তা হারিয়ে একটা পাহাড়ে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই মাইন বিস্ফোরণের শব্দ পাই। তাকিয়ে দেখি পেছনে থাকা আমার ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।”
মিয়ানমার সীমান্তের ভেতর চোখের সামনে স্থল মাইন বিস্ফোরণে গত সপ্তায় ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর কথা এভাবেই বেনারকে জানান নিহত রোহিঙ্গা কিশোর মো. জাবের (১১) এর বড়ভাই হামিদ হোসেন (১৬)।
তবে বিস্ফোরণটা যেখানে ঘটেছে সেটা বাংলাদেশ নাকি মিয়ানমার তা তারা জানতেন না বলে জানান হামিদ।
গত ২৩ অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের পুতে রাখা স্থল মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ যায় জাবেরের। উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের মো. এমদাদ হোসেনের ছেলে জাবের স্থানীয় একটি হেফজখানার ছাত্র।
“আমাদের সাথে আরো দুইজন থাকলেও ঘটনার পর তাঁরা পালিয়ে যায়। এদিকে মাইন বিষ্ফোরণে আহত ভাইকে একা কাঁধে করে কিছুদূর আনার পর আর পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে ওই অবস্থায় তাকে ওখানে রেখে মানুষ ডাকতে যাই, কিন্তু কেউ আসে না,” বলেন হামিদ।
হামিদ জানান, “পরে ঘরে খবর দিলে বাবাসহ পাঁচজন লোক আসে। বিজিবির (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) অনুমতি নিয়ে সেখানে যেতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। ততক্ষণে আমার ভাই মারা গেছে।”
“মানুষ মারার জন্য এভাবে সীমান্তে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখা অত্যন্ত নির্মম ব্যাপার, বর্বরোচিত কাজ,” মন্তব্য করে এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “সীমান্তে মাইন পুতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ করেছে।”
“রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর তাদের গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর আরেকটা কৌশল এটা। এটা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সহিংসতার অংশ। রোহিঙ্গাদের চাপে রাখতেই এই কৌশল অবলম্বন করছে মিয়ানমার,” বলেন তিনি।
দেশটির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে সোচ্চার হওয়ার দাবি জানিয়েছেন ড. দেলোয়ার হোসেন।
এ বিষয়ে বিজিবির কক্সবাজারের অধিনায়ক লে: কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তে প্রায় সময় স্থল মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। মূলত এই অংশ থেকে কেউ মিয়ানমার বর্ডার পার হতে গেলেই এই ঘটনা ঘটছে।”
“বারবারই আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠাই,” জানিয়ে কর্নেল আলী হায়দার বলেন, “সর্বশেষ রোহিঙ্গা কিশোর নিহতের ঘটনায়ও চলতি সপ্তায় প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে।
“তবে দেশটির পক্ষ থেকে এখনো উত্তর দেয়নি, হয়তো দেবে,” বলেন তিনি।
এদিকে গত এক বছরে সীমান্তে বিভিন্ন সময়ে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অন্তত আটজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে শুক্রবার বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহম্মদ সনজুর মোরশেদ।
তিনি বলেন, “এর মধ্যে পাঁচ জন মিয়ানমারে পালিয়ে যাবার সময় এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। বাকিরা মাছ ধরতে এবং রান্নার লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে মারা যায়।"
তবে কর্নেল আলী হায়দারের মতে, সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা “আগের চেয়ে অনেক কমে এসছে।”
জাবেরের পরিবারে শোকের মাতম
মাইন বিস্ফোরণে জাবেরের মৃত্যুর পর থেকে এখনো শোকের মাতম চলছে উখিয়ার কুতুপালং-এর লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত তার পরিবারে।
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন জাবেরের বাবা এমদাদ হোসেন (৫৭)।
তিন সন্তানের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন লম্বাশিয়া ক্যাম্পে।
বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে পরিবারটির সাথে দেখা হয় বেনার প্রতিবেদকের। সেখানে তখন নিহত জাবেরের কুলখানির আয়োজন চলছিল। ঘরজুড়ে শোকাবহ পরিবেশ।
জাবেরের মা নুরুন্নার বেনারকে বলেন, “আমার ছেলে হেফজখানার পড়ত। আগের দিন বৃহস্পতিবার হেফজখানা থেকে বাড়ি ফেরে। সেদিন সকালে লেখাপড়া খেলাধুলা করে ভাত খেয়েছে। আমি বলেছি, তোমরা কোথাও বের হয়ো না, ঘুমিয়ে থাকো।”
“কিছুক্ষণ পর একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসার অনুমতি চায়। ফেরার সময় মাছ, শাকসবজি খুঁজে আনব বলে চলে যায়। পরে আছরের সময় জেনেছি ছেলে বোমের (ল্যান্ডমাইন) উপর পড়েছে” বলেন নুরুন্নাহার।
চেহলামে অংশ নিতে আসা একই ব্লকের মাঝি মো. ইউসুফ বেনারকে বলেন, “আমরা খুব আতঙ্কে আছি। সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসের কারণে আমাদের ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা কিংবা শাক-সবজি তুলতে বর্ডারে যায়। কিন্তু বার্মা সরকার কাঁটাতারের বেড়ার পাশ দিয়ে ল্যান্ড মাইন বসিয়েছে।”
সীমান্তে গেলেই ল্যান্ড মাইনের শিকার হতে হয়’
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াছ বেনারকে বলেন, “২০১৭ সালের আগে থেকেই মিয়ানমার সরকার আমাদের বাড়ি ঘরের আশেপাশে, রাস্তাঘাটে ল্যান্ডমাইন বসিয়ে রাখত। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় রাস্তাঘাটে অনেক মানুষ ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে মারা গেছেন।”
তাঁর দাবি, ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় দুইশোরও বেশি মানুষ ল্যান্ড মাইন বিষ্ফোরণে মারা গেছেন। আহত হয়ে পঙ্গু হয়েছেন এ রকম সংখ্যাও শতাধিক।
“বার্মায় এত বেশি ল্যান্ড মাইন পোতা হয়েছে যে, ক্ষেতে খামারে যাওয়ার পথে, মাঠে গরু চরানোর কিংবা ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার সময় মানুষ ল্যান্ড মাইনে মারা যাচ্ছে,” বলেন ইলিয়াছ।
গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে মিয়ানমার সরকার ল্যান্ড মাইন বসাচ্ছে বলে দাবি করেন এই রোহিঙ্গা নেতা।
ঘুমধুম নো মেনস ল্যান্ড রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা দিল মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “আমরা নো মেনস ল্যান্ডে থাকায় সবসময় দুঃশ্চিন্তায় থাকি। কারণ, মিয়ানমার বর্ডার থেকে এর দূরত্ব কম। আর বর্ডারের কাছে গেলেই ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণের শিকার হতে হয়।”
জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থাগুলো থেকে গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়ায় এখন আর কেউ রান্নার লাকড়ি কুড়াতে যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে অনেকে গরু চরাতে, শাক তুলতে বা মাছ ধরতে যায়।”
“আবার মিয়ানমারে যাদের বাড়ি ঘর একদম বর্ডারের কাছে তাদের অনেকেও সেখানে ফিরতে চায়। এসব বুঝে মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে সীমান্তে স্থলমাইন বসাচ্ছে,” বলেন দীল মোহাম্মদ।