নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি রোহিঙ্গাদের

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2018.10.31
ঢাকা ও কক্সবাজার
181031-BD-rohingya-620.jpg রোহিঙ্গাদের সাথে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করতে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে পৌঁছান মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব উ মিন্ট থু। ৩১ অক্টোবর ২০১৮।
এএফপি

রাখাইনে ফেরার আগে মিয়ানমার সরকারের কাছে পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেওয়াসহ বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছেন সেনা নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।

বুধবার বাংলাদেশ সফররত মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসলে এসব দাবি তুলে ধরেন তাঁরা।

এসব দাবির মধ্যে রয়েছে; রোহিঙ্গাদের কেড়ে নেওয়া বসতভিটা ও জমিজমা ফেরত দিতে হবে। তাঁদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে নয়, নিজ গ্রামে ফেরত যেতে দিতে হবে। তাঁদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিচার করতে হবে।

আরো দাবির মধ্যে রেয়েছ; রাখাইনের যেসব জায়গায় রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গাদের উপর আর কোনো নির্যাতন না হয়।

রোহিঙ্গারা যেসব শর্তে মিয়ানমারে ফেরত যাবে, সেগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে ঘোষণা দিতে হবে, যাতে পরে দেশটি ওয়াদা ভঙ্গ করতে না পারে।

মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সাথে আলাপ করা একাধিক রোহিঙ্গা বেনারকে এসব তথ্য জানান।

রোহিঙ্গাদের দাবিগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দেননি মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব উ মিন্ট থু। পরে প্রেস ব্রিফিং এর সময় তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের দেয়া দাবিগুলো মিয়ানমার সরকারের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া হবে। পাশাপাশি বাকি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়েও আলোচনা করা হবে।

জানা যায়, এর আগে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব উ মিন্ট থু রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন।

এ সময় রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে তিনি জানান, শুরুতে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছই করার লক্ষ্যে আগে এনভিসি কার্ড নিতে হবে। ফেরার পর তাঁদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে রাখা হবে।

উ মিন্ট থু বলেন, “তোমাদের স্বাধীনতা দেবো, লেখা পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। বিয়ে করার পাশাপাশি রোহিঙ্গারা সেখানে ব্যবসা করতে পারবে।”

গত বছরে মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনের মুখ থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের আশ্রয় নেন আবদুর রশিদ (৫০)। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব যখন রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছিলেন তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

রশিদ বেনারকে বলেন, “তাঁকে জানিয়েছি, আমরা সকলে মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। তবে ক্যাম্পে নয়, নিজেদের গ্রামে। এছাড়া আমাদেরকে রোহিঙ্গা স্বীকৃতি এবং জাতীয় কার্ড দিতে হবে।”

মুসা আলী নামে আরেকজন রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসায় আমরা খুশি। কিন্তু তিনি যেসব শর্ত দিয়েছেন তা সন্তোষজনক নয়। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিলেই কেবল ফেরত যাব, অন্যথায় এখানেই থাকতে চাই।”

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে দুপুরে মিয়ানমারের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের প্রধান দেশটির পররাষ্ট্র সচিব উ মিন্ট থু সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

তিনি জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রত্যবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।

উ মিন্ট থু জানান, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের পাঠানো আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য পাঁচ হাজার জনের নাম যাচাই বাছাই করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রথম ধাপে দুই হাজার ও পরের ধাপে বাকিদের ফেরত নেয়া হবে।

“রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রস্তুতির মধ্যে স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানসহ যাবতীয় বিষয় রয়েছে,” জানান উ মিন্ট থু।

কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। ৩১ অক্টোবর ২০১৮।
কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। ৩১ অক্টোবর ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ
মিয়ানমার প্রতিনিধি দল ছাড়াও বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনসহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা।

মিয়ানমার প্রতিনিধি দলটি প্রত্যাবাসনের জন্য গঠিত ওয়ার্কিং গ্রুপের তৃতীয় বৈঠকে যোগ দিতে দুইদিন আগে ঢাকায় পৌঁছায়। মঙ্গলবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের তৃতীয় বৈঠকে অংশ নেন তারা।

দ্বিতীয় দফায় মিয়ানমারকে আরও ৫ হাজার ২১৩ পরিবারের ২৪ হাজার ২৪২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান মোহাম্মদ আবুল কালাম।

গত বছর ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে প্রাণে বাচঁতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাঁদের নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে’ ফেরাতে গত বছর ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ।

চুক্তি অনুসারে ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও এক বছর পেরিয়ে গেলেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এখন আসছে নভেম্বরে প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দেওয়া হলো।

তবে ঘোষণা দেয়ার পরেও প্রত্যাবাসন হবে কিনা তা নিয়ে জোর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

এদিকে রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত নয় বলে মঙ্গলবার মন্তব্য করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা।

উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিক বেনারকে বলেন, “আন্তজার্তিক চাপের কারণে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে। তবে আমরা তাদের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিহান। কারণ, তারা কখনোই প্রতিশ্রুতি পালন করে না। তাছাড়া তারা কীভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাইছে সেটাও দেখার বিষয়।”

৪৪ লাখ ডলার সহায়তা ঘোষণা

এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও কক্সবাজারে স্থানীয় জনগণের জন্য আরও ৪৪ লাখ ডলারের অর্থসহায়তা ঘোষণা করেছে ডেনমার্ক সরকার। দু’দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দেশটির উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী উল্লা টরনেস।

তিনি জানান, মানবিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যতভাবে সম্ভব মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করছে ডেনমার্ক।

দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে আসা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে জানান, তাঁদের যে তহবিল রয়েছে তা দিয়ে কয়েক মাস রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া যাবে। দীর্ঘমেয়াদে অর্থের সংস্থান বড় চ্যালেঞ্জ।

ডেভিড বিসলে বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই এর সমাধান খুজতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।