রোহিঙ্গা শিবিরে বিশেষ অভিযান, দুই দিনে গ্রেপ্তার ৬০
2022.10.31
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬০ জন গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) গত শনিবার রাত থেকে ‘অপারেশন রুট আউট’ নামের এই বিশেষ অভিযান শুরু করে।
এই অভিযানে “দুই দফায় ৬০জন রোহিঙ্গা অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে,” জানিয়ে শিবিরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার (অপস্ এন্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “শিবিরগুলোতে অপরাধীদের নির্মূল করতে এই অভিযান চলমান থাকবে।”
গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় দেশটির সামরিক বাহিনীর সাথে স্থানীয় বিদ্রোহীদের লড়াইর ফলে সেখান থেকে “বেশ কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী শিবিরগুলোতে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তারা শিবিরগুলোকে অশান্ত করে তুলেছে,” জানান ফারুক।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে পুলিশ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চায়নি। তবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, পুলিশের এই অভিযান মূলত আরসার বিরুদ্ধে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের হিসাবে, চলতি মাসে এক শিশুসহ নয় রোহিঙ্গা আরসার হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন রোহিঙ্গা।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক আবদুর রশিদ বেনারকে বলেন, মিয়ানমারের চলমান অস্থিরতার ফলে সেখানে সুবিধা করে উঠতে না পেরে অনেক আরসা সদস্যই কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে ঢুকে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা নেতা ও পুলিশের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও কমিউনিটি নেতারা আরসার টার্গেটে পরিণত হবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হামলার শিকার হচ্ছেন।
বালুখালী ৯ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের এক নেতা (মাঝি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “বর্তমানে কেমন আতঙ্কের মধ্যে আছি তা বলে বোঝাতে পারব না। আমরা তিন-চারজন মাঝি প্রতিদিন আছরের নামাজের পরে পুলিশ ক্যাম্পে ঢুকে যাই, পরদিন সকালে বের হই। এভাবে আমাদের দিন যাচ্ছে।”
এখন শুধু আরসা নয়, শিবিরে আরো কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে দাবি করে এই কমিউনিটি নেতা বলেন, “এসব বাহিনী খুনোখুনির ঘটনায় জড়িত।”
তিনি বলেন, মাঝিরা ক্যাম্প ইনচার্জ এবং পুলিশের সঙ্গে কাজ করার ফলে সন্ত্রাসীরা মনে করছে, “মাঝিরা তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। যে কারণে বিশেষ করে আরসা টার্গেট করে হামলা করছে।”
রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ থাকলেও আরসা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর নেতা শফি উল্লাহ।
তিনি বেনারকে বলেন, “আরসার মূল টার্গেট মাঝিরা। তারা মাঝিদের ডেকে তাদের ব্যাপারে প্রশাসনকে তথ্য দিলে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।”
একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনদিন, কার ওপর বিপদ আসে সেটা নিয়ে সবাই আতঙ্কিত থাকনে।”
ক্ষমা চেয়েছে মিয়ানমার
সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলি ও গোলা নিক্ষেপে হতাহতের ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিপি) ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশকে।
রোববার কক্সবাজারের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপে সাউদার্ন পয়েন্ট রিসোর্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও মিয়ানমারের বিজিপি’র মধ্যে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী পতাকা বৈঠক শেষে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “মাইন বিস্ফোরণ, মাদক চোরাচালান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে।”
মিয়ানমারের সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমার মংডুর ১ নম্বর বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্রাঞ্চের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কাও না ইয়ান শো।
গত আগস্টে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনাবাহিনী ও রাখাইন প্রদেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি ও মর্টার শেল বিস্ফোরণ। ২৮ আগস্ট থেকে বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের ছোড়া শেল এসে পড়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। তাছাড়া সীমান্তে গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনায় একাধিকবার মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ।
মুহিব উল্লাহ হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু
কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিন সোমবার ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মামলার বাদী ও মুহিব উল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহ সাক্ষী দিয়েছেন।
ওই আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) মোজাফ্ফর আহম্মদ হেলালী বেনারকে বলেন, মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে আরো দুজনের সাক্ষ্য নেয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে সকালে এই মামলার গ্রেপ্তার ১৪ আসামিকে জেলা কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মুহিব উল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।