রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যা: আরসার ১১৪ ‘কথিত’ সদস্যসহ এক মাসে গ্রেপ্তার ১৭২

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.11.01
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যা: আরসার ১১৪ ‘কথিত’ সদস্যসহ এক মাসে গ্রেপ্তার ১৭২ উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অভিযান। ২৩ অক্টোবর ২০২১।
[সৌজন্যে: এপিবিএন]

শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যার পর গত এক মাসে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বিশেষ অভিযানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ১১৪ ‘কথিত’ সদস্যসহ ১৭২ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। 

এপিবিএন অধিনায়ক মো. নাইমুল হক সোমবার সকালে সাংবাদিকদের বলেন, “গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত ‘তথাকথিত আরসা নামধারী’ ১১৪ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” 

“বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে অভিযান চলছে। দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে কাউকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না,” বলেন এসপি নাইমুল। 

প্রসঙ্গত, শিবিরের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও অস্থিরতার জন্য নিহতদের স্বজনেরা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসাকে দায়ী করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আরসার অস্তিত্ব নেই। 

সর্বশেষ এ বিষয়ে এপিবিএন অধিনায়কের দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে মুহিব উল্লাহর ভাগ্নে এবং রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) মুখপাত্র রশিদ উল্লাহ মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পগুলো আরসার অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি তাঁরা (সরকার) এখনো বিশ্বাস না করাতে আমরা হতাশ।” 

উখিয়ার কুতুপালং মেগাক্যাম্পের লম্বাশিয়া শিবিরের এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিব উল্লাহকে এবং বালুখালীর ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় আরো ছয়জনকে হত্যার ঘটনা সেখানে আরসা সক্রিয় থাকার প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন রশিদ।

তবে তিনি বলেন, “ক্যাম্পে পুলিশের তৎপরতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা খুশি।” 

মাদক ব্যবসা, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় আরো ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে এসপি নাইমুল জানান, চারটি দেশীয় তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র, চার রাউন্ড কার্তুজ, দুই রাউন্ড চায়না রাইফেলের গুলি, ১৪টি রামদাসহ আরো বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছেন তাঁরা। 

অভিযানে ১১ হাজারের বেশি পিস ইয়াবাসহ অন্যান্য অবৈধ জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে এপিবিএন অধিনায়ক বলেন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে পাঁচটি, ডাকাতির প্রস্তুতি সংক্রান্ত পাঁচটি, মাদকের ১৩টিসহ সর্বমোট ২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

এখনো ভয় কাটছে না

বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মো. রফিক সোমবার সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন, “সন্ত্রাসীরা এখনো গভীর রাতে প্রকাশ্যে এসে ক্যাম্পের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। যে কারণে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আতঙ্ক কাটছে না।” 

ক্যাম্পে ছয় জন নিহত হওয়ার পর থেকে লোকজন রাতে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে অন্য ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বজনদের কাছে চলে গেছে।” 

প্রসঙ্গত, মুহিব উল্লাহর স্ত্রী-সন্তানসহ মোট ১৭টি পরিবারের ৭৩ জন সদস্যকেও ইতিমধ্যে শরণার্থী শিবির থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেও রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে দাবি করে বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বেনারকে বলেন, “বর্তমানে শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরণের শঙ্কা, ভয় ও আস্থাহীনতা বিরাজ করছে।”

“সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি তারা গ্রেপ্তারের আতঙ্কেও ভুগছেন। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা প্রকৃত তথ্য পাচ্ছে সে বিষয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে,” যোগ করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির এই মহাসচিব। 

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ

বিশেষ অভিযানের নামে সাধারণ রোহিঙ্গাদের হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে রোহিঙ্গা ন্যাশনালিস্ট অর্গানাইজেশন (আরএনও) নামে একটি সংগঠন। এক বিবৃতিতে বৃহস্পতিবার তারা দাবি করেছে, অসৎ বার্তাদাতাদের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার ও সাজানো মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।

নিরপরাধ রোহিঙ্গা শিক্ষক ও প্রবীণদের গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়ে আরএনও বাংলাদেশ সরকারের কাছে এপিবিএন-এর এমন কর্মকাণ্ডের প্রতিকার চেয়েছে।

তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের (আরওয়াইএ) প্রতিষ্ঠাতা খিন মং সম্প্রতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গ্যানাইজেশনের (আরএসও) নেতা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের সহায়তায় তাঁরা গোপনে রোহিঙ্গা শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করছে। 

তবে যারা এই বিবৃতি দিয়েছে তারা আরসার পক্ষে কাজ করছে উল্লেখ করে খিন মং বেনারকে বলেন, “পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে আরসা সদস্য রয়েছে কিনা সেটি আমরা নিশ্চিত নই। তবে এটা সত্যি যে, ক্যাম্পের লোকজন এখনো ভয়ভীতির মধ্য দিন কাটাচ্ছে। কারণ প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।” 

“বিবৃতিটির ব্যাপারে আমরাও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এটা আরসার কাজ। তারা এখানে নতুন নামে, অর্থাৎ আরএনও-র ব্যানারে সংগঠিত হতে চাচ্ছে,” বলেন নূর খান লিটন। 

মুহিব উল্লাহ হত্যার ঘটনায় তাঁর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২৫ জনকে আসামি করে এবং মাদ্রাসায় নিহত আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম পরদিন ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ জনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা করেছেন। 

এই দুই মামলায় মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে মুহিব হত্যায় জড়িত ১০ জনকে আটকের কথা জানিয়ে এসপি নাইমুর বলেন, “তাদের মধ্যে তিনজন আসামি আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।” 

নতুন তিনটি পুলিশ ক্যাম্প

রোহিঙ্গা শিবিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়তা করতে তিনটি নতুন পুলিশ ক্যাম্প ভবন স্থাপন করে দিচ্ছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। এসপি নাইমুলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এগুলো লম্বাশিয়া, নৌকার মাঠ ও অক্সফাম (ক্যাম্প-৪) পুলিশ ক্যাম্প। 

“এর মধ্যে লম্বাশিয়া ও নৌকার মাঠ পুলিশ ক্যাম্পের নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে,” উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্যাম্প ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেখানে কর্তব্যরত পুলিশের আবাসন সমস্যার সমাধান হবে। 

“শরণার্থীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ইউএনএইচসিআরের জন্য অপরিহার্য,” উল্লেখ করে সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে জানান, সুরক্ষা সংস্থা হিসাবে তারা বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় মুহিব উল্লাহ হত্যার পর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। এর মধ্যে কিছু শরণার্থীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। 

“এই কঠিন সময়ে ইউএনএইচসিআর ভিকটিমদের হতবাক ও বিক্ষুদ্ধ পরিবার, তাদের সহযোগী ও আইনি সেবাদানকারীদের মানসিক সমর্থনসহ সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে,” বলেন সাজ্জাদ। 

ভাসানচরে প্রতিনিধি দল

ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তার কাজে জাতিসংঘের অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সাথে চুক্তি হওয়ার পর সোমবার প্রথমবারের মতো নোয়াখালীর ওই দ্বীপ ঘুরে দেখতে গেছে ইউএনএইচসিআর এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ প্রতিনিধি দল।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজোয়ান হায়াত এবং ভাসানচর প্রকল্পের উপ-পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ারুল কবির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি সেখানে তিন দিন অবস্থান করবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।