সীমান্তে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব
2018.11.07
ঢাকা

কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তে মিয়ানমার বর্ডার গার্ডের (বিজিপি) সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বুধবার দেশটির রাষ্ট্রদূত লুইন উ কে মন্ত্রণালয়ে তলব করে এই প্রতিবাদ জানানো হয়।
এদিকে ফের সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সেন্টমার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগর থেকে নারী-শিশুসহ ৩৩ জন রোহিঙ্গা ও ছয় বাংলাদেশি দালালকে আটক করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদস্যরা।
বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেনের সাথে দেখা করেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁর হাতে একটি কূটনৈতিক প্রতিবাদপত্রও তুলে দেওয়া হয়।
তবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।
প্রসঙ্গত, গত ৪ নভেম্বর দুপুর একটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তে তিন দফায় ৪১ রাউন্ড গুলি করে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড। ওই ঘটনায় একজন বাংলাদেশি কিশোর এবং এক রোহিঙ্গা নাগরিকসহ দুজন আহত হয়।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বেনারকে বলেন, “সীমান্তে গুলিবর্ষণের ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল। মৌখিক প্রতিবাদের পাশাপাশি তাঁর কাছে একটি কূটনৈতিক পত্রও দেওয়া হয়েছে।”
“এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে,” বলেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, কয়েক দিন পরেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নির্ধারিত দিন ধার্য রয়েছে। তার আগে এ ধরনের ঘটনা প্রত্যাবাসন স্থগিত করার জন্যও ঘটানো হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। বিষয়টি উল্লেখ করে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে।”
জানা যায়, ওই ঘটনায় হতাশা ব্যক্ত করে এর পূর্ণ তদন্ত করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৫ নভেম্বর দুই হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গার প্রথম দল মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার কথা।
কিন্তু দু’দেশ যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন সীমান্তে বিজিপি’র গুলিবর্ষণের এমন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি প্রত্যাবাসন বানচাল করার লক্ষ্যে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের মাত্র কয়েক দিন আগে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটাতে পারে। বিষয়টি আমরা দেশটির রাষ্ট্রদূতের কাছেও উত্থাপন করে জবাব চেয়েছি।”
“উত্তরে তিনি কিছু জানাননি। তবে বিষয়টি তিনি নিজ দেশে কথা বলে দেখবেন বলে জানান,” বলেন ওই কূটনীতিক।
বিশ্লেষকেদের মতে, মিয়ানমারের এমন আচরণ পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য এ ধরনের ঘটনা ইতিবাচক বলে মনে হয় না। এটার ব্যাপারে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার।”
“কারণ, যারা যাবে তারা যেন সেখানে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়, আশ্বস্তবোধ করে। বলা বাহুল্য, এ ধররে ঘটনা ঘটলে যারা প্রত্যাবাসনে যাবে তাদের মনে নানা ধরনের দুশ্চিন্তা দেখা দেবে। কাজেই এটা অবাঞ্ছিত, মিয়ানমারের জন্য এ ধরনের ঘটনা এড়িয়ে চলাই ভালো,” বলেন তিনি।
এর আগে মিয়ানমার একাধিকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং সীমান্তে স্থলমাইন স্থাপন করেছে যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থী। সেসব ঘটনায় একাধিকবার দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়।
সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর লুইন উ কে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ, মিয়ানমার সরকারের জনসংখ্যা বিষয়ক বিভাগের ওয়েবসাইট তাদের দেশের যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপপুঞ্জকে তাদের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আহতরা চিকিৎসাধীন
গত ৪ নভেম্বর গুলিবর্ষণের ঘটনায় গুলিবিদ্ধরা হলেন পালংখালী ইউনিয়নের রহমতবিল গ্রামের শাহাব উদ্দিনের ছেলে জয়নাল আবেদিন (১৩) এবং উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১ এর বাসিন্দা আমির হোসেনের ছেলে নুরুল ইসলাম।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, জয়নাল ও নুরুল ইসলাম সীমান্তের সাথে লাগোয়া উখিয়ার বালুখালীর রহমত বিল এলাকার স্থানীয় আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে রাখাল হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তারা গরু চরাতে গিয়েছিলেন।
এসময় সীমান্তের ওপার থেকে বিজিপি সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে তারা দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে উখিয়ার কুতুপালং রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, আহত দুজনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে। তাদের অবস্থা অগের তুলনায় ভালো।
বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল বেনারকে জানান, “উখিয়ার সীমান্তে বিজিবি সর্তক অবস্থানে রয়েছে।”
“তাছাড়া গত রোববার জিরো পয়েন্টের ওপার থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি কয়েক দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে,” বলেন তিনি।
বঙ্গোপসাগর থেকে ৩৯ জন আটক
বুধবার বিকেলে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে ৬ কিলোমিটার দূরে সাগরে একটি নৌকাসহ ৩৩ জন রোহিঙ্গা ও ছয়জন বাংলাদেশি দালালকে আটক করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কোস্ট গার্ড টেকনাফ স্টেশনের লে. কমান্ডার ফয়জুল ইসলাম মন্ডল।
তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১০জন নারী ৯জন শিশু, ১৪জন পুরুষ।
দালালদের মাধ্যমে সাগর পথে যাত্রী ভর্তি একটি নৌকা মালয়েশিয়া পাড়ি জমাচ্ছে, এমন গোপন সংবাদ পেয়ে কোস্ট গার্ডের একটি দল অভিযান চালিয়ে নৌকাসহ তাদের আটক করে টেকনাফ স্টেশন কার্যালয়ে নিয়ে আসে।
আটক যাত্রীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দুই দিন আগে আটক দালালদের মাধ্যমে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন নোয়াখালী ঘাট এলাকা দিয়ে তারা সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দ্যেশে রওনা দেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সাগরের অদূরে একটি বড় জাহাজে তাদের তুলে দেবার কথা ছিল।
ফয়জুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়াগামীরা সবাই গত বছর ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা।
এর আগে মঙ্গলবার ভোরে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রকালে ১৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বিজিবির সদস্যরা।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।