রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মিয়ানমার
2018.11.07

অবশেষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। প্রথম দফায় ২২৬০ জনেরও বেশি হিন্দু ও মুসলিম শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিচালিত নির্দয় সামরিক অভিযানের শিকার হয়ে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। বছরখানেক আগে সম্পাদিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তির অধীনে তাঁদের ফেরত নেওয়া হচ্ছে।
মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রথম দলটিকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আসিয়ান বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক সোয়ে হান জানান, তাঁদের দেশের কর্মকর্তারা রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার তাং ফো লেওয়ে এবং নাগ খুয়ায় গ্রামের দুই অভ্যর্থনা কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ জন করে রোহিঙ্গা গ্রহণ করবেন।
“কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম প্রত্যাবাসন শুরু করার ব্যাপারে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়,” তিনি জানান।
“যেসব শরণার্থী নৌকায় ফিরবেন তাঁদের নাগ খুয়া কেন্দ্র থেকে এবং যারা সড়ক পথে ফিরবেন তাঁদের তাং ফো লেওয়ে কেন্দ্র থেকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আওতায় নেওয়া হবে।”
মংডু জেলার উপ-প্রশাসক ইয়ে হু বলেছেন, “উভয় কেন্দ্রই তাঁদের গ্রহণ করার জন্য বর্তমানে প্রস্তুত আছে। নির্ধারিত ফরম পূরণ করার কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাঁদের আমরা শুধু এক রাতের জন্য সেখানে রাখব।”
সোয়ে হান বলেছেন, “২৩ নভেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে যতজন শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে তার চেয়েও বেশি শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার কাজ করছে।”
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দলে থাকবেন ২০০০ শরণার্থী।
যাদের ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাঁরা সবাই ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের সময় যে ৭ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তাঁদের অংশ। ওই অভিযানে মিয়ানমার সেনারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন চালিয়েছিল।
প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ৮০৩২ শরণার্থীর নামের তালিকা দিয়েছে, যার মধ্যে মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তারা ৬০০০ জনকে ফেরত নেওয়ার যোগ্য হিসেবে যাচাই করেছেন। যাচাইকৃত শরণার্থীদের মধ্যে প্রথম দলে ২২৬০ রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরে যাবে।
দুটি কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর তাঁদের পূর্বের আবাসভূমিতে ফেরত নেওয়ার আগে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফো খং গ্রামের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হবে।
“প্রতিটি ট্রানজিট ক্যাম্পে আট কক্ষের ৬২৫ টি ভবন রয়েছে যেখানে ৩০ হাজার লোক রাখা যেতে পারে,” ইয়ে হু বলেন।
মিয়ানমারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-মহাপরিচালক থান তুন আং বলেন, “ক্যাম্প এবং উভয় অভ্যর্থনা কেন্দ্রে স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ১০ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন।”
তিনি বলেন, “শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য সরকার কাজ করছে। আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। আমরা তাঁদের সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিশুদের টিকাদান এবং গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করব।”
“আমরা ক্লিনিকগুলোতে জরুরি সেবা এবং মংডু হাসপাতালে রোগীদের স্থানান্তর করতে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রেখেছি,” বলেছেন তিনি।
নিরাপত্তা শঙ্কা
নভেম্বরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সফরকালে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ট থু অঙ্গিকার করেছিলেন যে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে তাঁদের ফেরত নেওয়া শুরু হবে।
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের আগেই তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্বের দাবি জানিয়ে আসছেন। একই সাথে তাঁরা 'রোহিঙ্গা' পরিচয়ের স্বীকৃতিও দাবি করেছেন।
এদিকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করে আসছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসাবে দেখা হয় এবং কয়েক দশক ধরে তারা মিয়ানমারে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে।
হংকং-ভিত্তিক ইউনিয়ন অফ ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের কেন্দ্রস্থল মংডু, বুথিডং এবং রথেডং জেলার দেড় হাজারেরও বেশি রাখাইন বৌদ্ধ গত ৪ নভেম্বর মংডুতে সমবেত হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াঙহি লি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন শুরু করার পরিকল্পনা বন্ধ করার জন্য মঙ্গলবার বাংলাদেশকে আবেদন জানিয়ে বলেন, “রোহিঙ্গাদের ওপর আবারও নির্যাতন এবং সহিংসতা হবে না, এরকম নিশ্চয়তা প্রদান করতে মিয়ানমার সরকার ব্যর্থ হয়েছে।”
“রোহিঙ্গারা তাঁদের মৌলিক অধিকার নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবে এমন পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমার সরকার দৃঢ় ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আমি মিয়ানমার সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ দেখিনি যাতে বিশ্বাস করা যায় যে, রোহিঙ্গারা তাদের মূল আবাসভূমিতে ফিরতে পারবে,” লিখিত এক বিবৃতিতে লি বলেন।
যেসব শরণার্থীর নাম প্রত্যাবাসনের তালিকায় উঠেছে, তারা সবাই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তথ্য পেয়েছেন লি।
এদিকে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার গত সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, “দেশে ফেরত যেতে ইচ্ছুক কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা না বলেই তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।”
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়া।