রোহিঙ্গা শরণার্থী গণনায় হিমশিম বাংলাদেশ
2017.11.08
কক্সবাজার

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে শুধু আঙুলের ছাপ, ছবি আর নাম ও বয়সের মতো সহজ তথ্যসংবলিত বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করতে গিয়েও রোহিঙ্গা নারী সানজিদা বেগমকে বেশ নার্ভাসই মনে হচ্ছিল।
সানজিদা (২৯) উখিয়ার একটি শিবিরে গত আট বছর ধরে স্বামীর সাথে বসবাস করছেন বলে জানান। তাঁর তিন সন্তানের সবারই জন্ম বাংলাদেশে।
তবে নিবন্ধন শেষে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ লেখা নতুন কার্ড গলায় ঝুলিয়ে বের হয়ে এসে কোনো ভণিতা ছাড়াই সানজিদা বেনারকে বলেন, “আমি তাদের মিথ্যা বলেছি। তাদের বলেছি যে আমি মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে এসেছি।”
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের তারিখে গড়বড় উখিয়া ও টেকনাফের সাতটি বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কেন্দ্রেই একটি সাধারণ ঘটনা। এর ফলে আগস্টের পর থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তা যোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে জানান, এই নিবন্ধন কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন ও পুরোনো সব রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঠিক সংখ্যা নির্ণয়।
তবে এখন পর্যন্ত “নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের আনুমানিক সংখ্যা মূলত মাঠ পর্যায়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা, স্থানীয় কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গা নেতাদের প্রাথমিক হিসাবের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “শরণার্থীদের ঘন ঘন স্থান বদল ও সংস্থাগুলোর জরুরি বিষয়গুলোতে বেশি মনযোগী থাকার কারণে এখন পর্যন্ত একই ব্যক্তি যাতে দুইবার গণনায় অন্তর্ভুক্ত না হন; সেরকম পদ্ধতিগত জনগণনা সম্ভব হয়নি।”
তবে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা “খুব সম্ভবত আনুমানিক সংখ্যা থেকে বেশি হবে” মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন সীমান্তপথে রাতের বেলা হেঁটে বা নৌকায় প্রবেশ করে।”
গত আগস্টের শেষ দিকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকগুলো চৌকিতে একযোগে হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে।
এর ফলে বাংলাদেশে নজিরবিহীন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয় এবং মাত্র দুই মাসে তা ছয় লাখ ছাড়িয়ে যায়।
রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচে বড়ো দেশহীন গোষ্ঠী। মিয়ানমার সরকার তাঁদেরকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ তাঁদেরকে শরণার্থীর মর্যাদা না দিয়ে ‘বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে গণ্য করে।
কার্ড থাকলে কিছু সুবিধা হয়
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আইওএম এর হিসাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ১৫টি শরণার্থী শিবিরে বাস করেন।
ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে নভেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত সাড়ে চার লাখ শরণার্থীর বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শেষ হয়েছে।
তবে কুতুপালং শিবিরের ৩০টি নিবন্ধন বুথের একটিতে কর্মরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য মোহাম্মদ তৌফিক উদ্দিনের মতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হওয়া রোহিঙ্গাদের ভেতর কতজন নতুন অনুপ্রবেশকারী তা নির্ধারণ করার ‘কোনোই উপায় নেই।”
“আমরা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করে ফেলার লক্ষ্য রেখেছি,” বলেন তৌফিক।
নিবন্ধন শেষ হওয়ার পর “শুধু নিবন্ধন কার্ডধারীরাই ত্রাণ সামগ্রী পাবে,” জানান তিনি।
তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হলেও এর ফলে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করাও বন্ধ হবে।
“আমরা আগে আঙুলের ছাপ দেইনি কারণ আমার স্বামী দিনমজুর হিসেবে কাজ করত এবং তার আয়ে আমাদের বেশ ভালোই চলত। কিন্তু নতুন করে রোহিঙ্গাদের আসার পর ক্যাম্পে খুব কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। ফলে এখন তার পক্ষে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া খুব কঠিন,” বেনারকে বলেন সানজিদা।
“এটা (বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন) থাকলে আমরা অন্তত রিফিল পাব,” যোগ করেন তিনি।
“আমি বাংলাদেশি হতে চাই’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার বরাতে ঢাকা ট্রিবিউন জানায়, গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।
অক্টোবরের ২০ তারিখ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হাসান (২০) এই কারণেই নিবন্ধন করতে রাজি নন বলে বেনারকে জানান।
“আঙুলের ছাপ দেবার সাথে সাথে আমি রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাব। এক পর্যায়ে আমাকে মিয়ানমার ফেরত পাঠানো হবে, যেখানে আমার কোনো অধিকারের স্বীকৃতি নেই। আমি বাংলাদেশি হতে চাই, যাতে আমি হয় এখানে থাকতে পারি, অথবা আয়ের জন্য বিদেশ যেতে পারি,” বেনারকে বলেন হাসান।
জনগণনা পদ্ধতি
নিডস এন্ড পপুলেশন মনিটরিং (এনপিএম) নামের একটি পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের জনগণনা করা হয় বলে জানায় আইওএম।
এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মৌলিক তথ্য বিষয়ক সাক্ষাৎকার ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গাদের আনুমানিক সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।
“এনপিএম দুটো পরস্পর সম্পর্কিত মূল কৌশলের ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে দৈনিক অনুপ্রবেশ মনিটরিং, যা দিয়ে নতুন অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা গণনা করা হয়, এবং মাসিক সাইট এসেসমেন্ট, যা দিয়ে প্রত্যেক শরণার্থী কোথায় অবস্থান করছেন তা শনাক্ত করা হয়,” বেনারকে বলেন আইওএম এর ন্যাশনাল কমিনউনিকেশনস অফিসার শিরিন আখতার।
“এনপিএম কর্মীরা নতুন আসা পরিবারগুলোকে পর্যবেক্ষণ ও তাঁদের মূল ঠিকানা সংগ্রহ করে, যাতে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে ছোটাছুটি করা অন্যদের থেকে তাঁদের আলাদা করা যায়,” বলেন শিরিন।
তিনি জানান, প্রতি রাতে প্রতিটি অনুপ্রবেশ পথের দায়িত্বে থাকা গণনাকারীরা ওই দিন ও আগের রাতে সংগ্রহ করা তথ্য কবো নামক একটি সফটওয়ারের মাধ্যমে কেন্দ্রে পাঠায়।
প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে “সবগুলো আশ্রয় কেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে একবার মোট শরণার্থী সংখ্যা, প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা, মূল ঠিকানা এবং অনুপ্রবেশের তারিখ সংগ্রহ করা হয়,” বলেন শিরিন।