চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ: মিয়ানমার
2018.11.09
ঢাকা

মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া রোহিঙ্গা তালিকায় অর্ধশতাধিক ‘সন্ত্রাসী’ রয়েছে বলে দাবি করেছে মিয়ানমার। বাংলাদেশকে তারা এদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে দেশটির অভিযোগ।
বর্তমানে ওই সন্ত্রাসীরা কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান করছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।
শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের কোনো সন্ত্রাসী এপারে নেই। বাংলাদেশে তাদের জায়গা পাওয়ার সুযোগই নেই।”
যদিও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আসিয়ান বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক সোয়ে হান বৃহস্পতিবার বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, “মিয়ানমার চিহ্নিত এই সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা বাংলাদেশকে দিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।”
“যেই তালিকার কথা বলা হচ্ছে সেটি এখনও আমাদের (পুলিশের) হাতে পৌঁছেনি,” এ প্রসঙ্গে বলেন ইকবাল।
প্রত্যাবাসনের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারকে ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়। এরপর যাচাই-বাছাই শুরু করে দেশটি।
সোয়ে হানের দাবি, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকা যাচাই-বাছাইকালে ৬ হাজার ৪৭২ রোহিঙ্গার মধ্যে ৫৪ জনকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তারা। তবে তারা কোথায়, কবে ও কী ধরনের সন্ত্রাসবাদে জড়িত ছিল, সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি।
নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক কারণে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করছে না বলেও উল্লেখ করেন হান। শুধু বলেন, “যদি তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়, তবে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালামও এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বেনারকে বলেন, “তালিকাটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে কমিশন খুব বেশি জানে না।”
“তবে আমাদের দেশে মিয়ানমারের সন্ত্রাসীদের অবস্থানের অভিযোগ অবশ্যই অসত্য,” যোগ করেন তিনি।
যদি এমন কোনো তালিকা পুলিশের হাতে আসে, তবে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল।
ফিরে যেতে বাধ্য করা হবে না
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম বলেন, ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু তারা ফিরে যেতে আগ্রহি কিনা, এ বিষয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে খুব শিগগির এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।
কমিশনার আরও বলেন, কাউকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হবে না।
ওদিকে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ৪ হাজার ৬৫৪ জন রোহিঙ্গাকে সত্যায়িত করেছে, যারা ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সামরিক অভিযান চলাকালে উত্তর রাখাইন ত্যাগ করেছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৭৬৪ জন চিহ্নিত হয়েছেন, যাদের কাছে এমন কোনও তথ্য বা দলিল নেই, যাতে তারা নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক বলে প্রমাণ করতে পারে।
“যদি এমন কিছু উপস্থাপন করতে পারে যাতে প্রমাণিত হয় যে তারা রাখাইনে বাস করতেন, তবে আমরা তাদের পূনরায় সত্যায়িত করব,” বলেন সোয়ে হান।
রাজনীতি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “যদিও মিয়ানমার বলছে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু আইনি জটিলতায় অনেকের প্রত্যাবাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যেতে পারে।”
“নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশকে কখনোই আর ফেরত নেবে না মিয়ানমার,” এমনটাই মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।
প্রত্যাবাসনে আপত্তি ৪২ সাহায্য সংস্থার
গত ৩০ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠকে দুই দেশের কর্মকর্তারা নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে পাঠানোর পরিকল্পনা করে। তবে এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর।
সর্বশেষ শুক্রবার ৪২টি সংস্থা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমারে যেতে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আতঙ্ক বোধ করছে।
মিয়ানমারের রাখাইন ও বাংলাদেশের কক্সবাজারে সক্রিয় এই সংস্থাগুলোর দাবি, মিয়ানমারে এখন ফিরে গেলে কী হবে তা ভেবে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা এবং এ ব্যাপারে তথ্য না পেয়ে তারা বিপর্যস্ত।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, শরণার্থীদের শঙ্কা, মধ্য রাখাইন রাজ্যে যেভাবে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে এক জায়গায় আটক রাখা হয়েছে, প্রত্যাবাসনের আওতায় ফেরত গেলে তাদেরও সেভাবেই রাখা হবে।
রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জের ধরে মধ্য রাখাইন অঞ্চলে ২০১২ সাল থেকে ছয় বছর ধরে তাদের ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিবাদ প্রচারে গ্রেপ্তার ১৫
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে জঙ্গিবাদ প্রচারের অভিযোগে ঢাকা ও কক্সবাজার থেকে দুই দিনে মোট ১৫ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর মধ্যে সাত জনকে কক্সবাজারের কলাতলীর একটি হোটেল থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দীন খন্দকার।
এর আগে বুধবার রাতে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর ডিওএইচএস থেকে আট জনকে গ্রেফতার করে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতরা জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত, যার তথ্য প্রমাণ রয়েছে।”
ওই ১৫ জনই ‘স্মল কাইন্ডনেস বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিও’র সাথে জড়িত। গত আগস্ট মাসে এনজিও ব্যুরো কর্তৃক জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যপরিচালনার অপরাধে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এই এনজিওটির কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়।
পুলিশের দাবি, সংস্থাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আল খিদমত ফাউন্ডেশনের সাথেও সম্পৃক্ততা আছে তাদের।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছে প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গা। গত বছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই এসেছে এদের প্রায় ৮০ শতাংশ।
রোহিঙ্গা শিবিরে যাবেন বার্গনার
কক্সবাজারে শুক্রবার রাতে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনার ও আরআরআরসি আবুল কালামের সাথে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠক শেষে বার্গনারের বরাত দিয়ে কালাম সাংবাদিকদের বলেন, “রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে।” শনিবার উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে পরিদর্শন করতে পারেন বার্গনার।
‘ইতিবাচক’ ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি চীনের
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন ইতিবাচ ও গঠনমূলক ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বেইজিংএ বাংলাদেশ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এক সম্মেলন শেষে এই ঘোষণা দেন চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক ভাইস মিনিস্টার কং জুয়ানু।
ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।
প্রতিবেদনে টেকনাফ থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।