রোহিঙ্গা শরণার্থী: কেউ পাচ্ছে না খাবার, কেউ বাজারে বিক্রি করছে ত্রাণ
2017.11.10
কক্সবাজার

কড়া নজরদারি সত্ত্বেও উখিয়ার জামতলি শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নারীদের দেখা গেলো ত্রাণের জিনিসপত্র খোলা বাজারে বিক্রি করছেন। প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার প্রতি দুই সপ্তায় একবার করে এই ত্রাণগুলো পায়।
দেখা গেলো রোহিঙ্গা নারী রাশেদা বাজারের অর্ধেক দামে সাত লিটার তেল আর তাঁর প্রতিবেশী দুই সন্তানের মা শাহিদা ২৫ টাকা দরে ৫০ কেজি চাল বিক্রির চেষ্টা করছেন।
“আমার ঘরে তিন বাচ্চাসহ মাত্র পাঁচজন মানুষ। অত রেশন দিয়ে আমরা কী করব?”- বেনারের কাছে এভাবেই ত্রাণ বিক্রির যুক্তি দিলেন রাশেদা (২৭)।
পরিবারে লোক সংখ্যা যাই হোক না কেন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে একই পরিমাণ চাল, ডাল ও খাবার তেল দেওয়া হয়।
এদিকে খাবারের অভাবে উপাস থাকতে হয় বলে বেনারকে জানান কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এগারো জনের পরিবারের সদস্য মোহাম্মদ জাভেদ (১৮)। তিনি জানান, তাঁর পরিবারে কোনোমতে দৈনিক মাত্র এক বেলা খাবার জোটে।
“রেশন মোটেই যথেষ্ট না। কিন্তু আমাদের কোনোমতে এগুলো দিয়েই চালাতে হচ্ছে। এই রেশন দিয়ে দুই সপ্তাহ চালানোর জন্য আমরা কম করে খাই,” বেনারকে বলেন জাভেদ।
বিতরণ প্রক্রিয়ায় ঘাটতি
কর্তৃপক্ষের মতে কক্সবাজারের ১৫টি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ সামগ্রী বিক্রির ঘটনা মূলত ঘটছে ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়ার জন্য।
“পরিবারে সদস্য সংখ্য যাই হোক না কেন, প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে একই পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।
শরণার্থীদের জন্য প্রতিদিন ৩৫০ টন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয় বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “হয়ত বিতরণ প্রক্রিয়ায় কিছু ঘাটতি আছে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে, আগস্টে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশে এই সংকট শুরু হয়, তখন প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের মতো যথেষ্ট সময় বা লোকবল কোনোটাই আমাদের ছিল না।”
“যার ফলে আমাদেরকে পরিবারগুলোর একটি গড় সদস্য সংখ্যা ধরে ত্রাণ বিতরণ শুরু করতে হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
গত আগস্টের শেষ দিকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ৩০টির মতো চৌকিতে একযোগে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আক্রমণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান চালায়। এর ফলে ২৫ আগস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
পুষ্টিহীনতায় ৪০ হাজার শিশু
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ছয় মাস থেকে ৫ বছর বয়সী প্রায় চল্লিশ হাজার শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)। এই শিশুদের জন্য জরুরি জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও সংস্থাটি জানায়।
সংস্থাটির মতে, “আইআরসির ধারণায় অপুষ্টির হার আরোও বেশি, বিশেষত যখন সম্পূর্ণরূপে পরিস্থিতিটি সামাল দেবার কথা বিবেচনা করা হবে।”
আইআরসির হিসেবে সামনের কয়েক সপ্তায় আরো প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ মানবিক সংকট পরিস্থিতি আরো শোচনীয় করে তুলবে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে সদস্য সংখ্যা গড়ে পাঁচ জন ধরে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয় বলে জানায় ২৫ আগস্ট থেকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৯ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টান চাল বিতরণকারী বিশ্ব খাদ্য সংস্থা।
“আমরা প্রতি দুই সপ্তায় প্রতিটি পরিবারে ২৫ কেজি চাল, সাড়ে চার কেজি ডাল ও দুই লিটার খাবার তেল বিতরণ করি,” বেনারকে বলেন বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মুখপাত্র শেলি ঠাকরাল।
কিছু পরিবারের ত্রাণ বিক্রির ঘটনা তিনি জানেন বলে বেনারকে জানান শেলি।
“এই রকম পরিস্থিতিতে, যেখানে শরণার্থীরা সবকিছু হারিয়েছে, এবং মৌলিক চাহিদা পুরণের জন্য হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ঔষধ বা ঘর বানানোর সামগ্রীর মতো প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে শরণার্থীদের কেউ কেউ মাঝেসাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিক্রি করতেই পারে। তবে সেসব আমাদের দেখার বিষয় না। যাদেরকে দেবার কথা তাঁদেরকে খাদ্য সামগ্রীগুলো বিতরণ করার পর সেটা দিয়ে তাঁরা কী করবে না করবে সেসব তাঁদের বিষয়,” বলেন শেলি।
‘ত্রাণ বিক্রি অবৈধ’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জানান, ত্রাণ সামগ্রী কেনা ও বেচা দুইটাই অবৈধ।
তিনি জানান, গত মাসে ত্রাণ বিক্রির সময় ২৫ জন রোহিঙ্গাকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) আটক করেছিল। পরে তাঁদেরকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
“আমরা তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, তাঁরা এখন যে পরিমাণ ত্রাণ পাচ্ছে তা দিনে দিনে কমে আসছে। আরো মাস দুয়েক পরে হয়ত তারা কিছুই পাবে না। সুতরাং বিক্রি না করে তাঁদের উচিত জিনিসগুলো জমিয়ে রাখা,” বলেন আলী হোসেন।
তিনি জানান, এই সপ্তার শুরুর দিকে কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে ত্রাণ সামগ্রী কেনার সময় ১০জন বাংলাদেশিকে বিজিবি গ্রেপ্তার করেছে।
“তাঁদেরকে এক থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে,” বলেন আলী হোসেন।
কিন্তু কক্সবাজার শহরের দোকানী আবুল হোসেনের (৪৮) কাছে এই গ্রেপ্তারে কিছু যায় আসে না। তাঁর হিসাবে “খুবই লাভজনক” হওয়ায় তিনি নিয়মিতই শরণার্থীদের কাছ থেকে চাল, ডাল, চিনি ও লবণ কেনেন।
“আমি তো তাঁদেরকে ত্রাণ বিক্রির জন্য জোর করি না। তাঁরা স্বেচ্ছায় এগুলো বিক্রি করে। এখানে কেউ কাউকে ঠকাচ্ছে না, তা হলে এটা অপরাধ হবে কেন?” বেনারকে বলেন আবুল হোসেন।