ভাসানচরে ‘বন্দি’ রোহিঙ্গাদের মুক্তি দাবি মানবাধিকার সংগঠনের

পুলক ঘটক ও সুনীল বড়ুয়া
2020.11.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
201113-BD-Fortify-Rohingya_1000.jpg মিয়ানমারে ফেরত যেতে না চেয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ। ১৫ নভেম্বর ২০১৮। [এপি]
[এপি]

নোয়াখালীর ভাসানচরে অবস্থানরত তিন শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ‘বন্দি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস।

এছাড়া কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা সবকিছু জেনে বুঝে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত ওই দ্বীপে তাঁদের স্থানান্তর প্রক্রিয়াও বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

এদিকে ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে কক্সবাজারে নিয়ে আসার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত হলেও এখনো দিন-তারিখ ঠিক হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন সরকারের কর্মকর্তারা।

“ভাসানচর একটি বন্দি শিবির। সেটি শরণার্থীদের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়,” বলে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন ফোর্টিফাই রাইটসের আঞ্চলিক পরিচালক ইসমাইল ওল্ফ।

তিনি জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের ওই দ্বীপে নির্বিঘ্নে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রায় ছয় মাস আগে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তর করার সময় থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ওই দ্বীপে বন্দিদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, মারধর এবং হুমকিসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি করে ফোর্টিফাই রাইটস।

“সরকার রোহিঙ্গা নরনারী এবং শিশুদের ওই দ্বীপে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রেখেছে। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আটককৃতদের যোগাযোগও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁদের ওপর মারধর এবং অন্যান্য খারাপ আচরণের অভিযোগ এসেছে। সেখানে আটককৃতরা তাঁদের পরিবারের সাথে পুনরায় মিলিত হতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন,” বিবৃতিতে বলেন ইসমাইল ওল্ফ।

অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে গত মে মাসে ভাসানচরে নিয়ে যায় সরকার।

তখন বলা হয়েছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সঙ্গনিরোধে রাখার জন্য তাঁদেরকে ওই দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেলেও তাঁদেরকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তর করা হয়নি।

ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে আসার জন্য সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা অনশন ধর্মঘটও করেন গত সেপ্টেম্বরে। ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছেন ১৮৬ জন নারী, ৯৬ জন পুরুষ এবং ২৪টি শিশু।

কক্সবাজারে আনার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত

সমুদ্র থেকে উদ্ধার করার পর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া তিন শতাধিক রোহিঙ্গা সেখানে থাকতে না চাওয়ায় তাঁদেরকে কক্সবাজারে আনার বিষয়ে সরকার ‘নীতিগত’ সিন্ধান্ত নিয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা বিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন।

“তাঁদের অনেকের আত্মীয় স্বজন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অবস্থান করায় সেখানে (ভাসানচরে) তাঁরা থাকতে চাইছেন না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তাঁদেরকে কক্সবাজারে আনার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

“তবে ঠিক কবে সেখানে নেওয়া হবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি,” জানান দেলোয়ার হোসেন।

ভাসানচরকে বসবাস উপযোগী করতে ওই দ্বীপে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ রোহিঙ্গাদের জীবিকার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা “ভালো আছে।”

তবে ভাসানচরে থাকা এক তরুণ রোহিঙ্গা ফোর্টিফাই রাইটসকে বলেন “আমাদের এখানে আটকে রাখার কারণে আমরা হতাশায় ভুগছি। মা-বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না।”

এদিকে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ভাসানচরে নেবার পরিকল্পনা সম্পর্কে দেলোয়ার হোসেন জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধাপে ধাপে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়ার নেওয়া হবে।

“প্রথম ধাপে প্রায় তিনশ পরিবারকে নেওয়া হতে পারে। তাঁরা স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে রাজি হয়েছেন,” বলেন দেলোয়ার হোসেন।

চলতি নভেম্বরেই ওই পরিবারগুলোকে ভাসানচরে নেবার কথা থাকলেও “এখন পর্যন্ত তারিখ নির্ধারিত হয়নি” বলে জানান তিনি।

এছাড়া জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকেও ভাসানচর পরিদর্শনে নেওয়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলছে বলে জানান দেলোয়ার হোসেন।

কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখের মতো রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে সরিয়ে নেবার জন্য নিজস্ব অর্থে সেখানে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে সরকার।

তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সেবাসংস্থাগুলোর বিরোধিতার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা যায়নি।

শরণার্থীদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা বসবাসের উপযোগী কি না তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে সেখানে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে নিয়ে যায় সরকার।

তাঁরা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে ‘মুগ্ধ’ হলেও ফিরে এসে জানান, সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসার জন্য আকুতি জানিয়েছেন তাঁদের কাছে।

“কাউকে জোর করে সেখানে রাখা উচিত হবে না। যারা ভাসানচরে আছে, তাঁরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে। আবার উখিয়া-টেকনাফে তাঁদের স্বজনেরাও বেশ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে,” বেনারকে বলেন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের সেক্রেটারি মাস্টার মো. ইলিয়াছ।

তিনি বলেন, “আমাদের দাবি, ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে নিয়ে আসা হোক। আর যারা ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে চায়, তাদের নিয়ে গেলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”

তাঁর মতে, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাঁদের মতামত নিয়েই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হোক।”

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

এছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভাসানচরে।

ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।