স্বঘোষিত আরসা সদস্যের দাবি, রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য লড়াই করছে তারা
2017.11.14
কক্সবাজার

সম্প্রতি বেনারনিউজের কাছে এক সাক্ষাৎকারে গত বছর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন সেই হামলায় অংশ নেওয়া এক রোহিঙ্গা যুবক নুরুল ইসলাম (২৮)।
রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রায় দেড় শত সদস্য কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন বলে সাক্ষাৎকারে জানান এই রোহিঙ্গা যুবক।
চাল-চলন ও পোশাক-আশাকে অন্য দশজন রোহিঙ্গার মতো সাধারণ এই যুবক। তিনি রাবারের স্যান্ডেলের সাথে খয়েরি টিশার্ট আর জিন্স পরে কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বেনারের কাছে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে বর্ণনা করেন ২৫ আগস্ট ভোর রাতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে আরসার সমন্বিত হামলার ঘটনা।
তবে মোট চারটি শর্তে নুরুল বেনারের সাথে কথা বলতে রাজি হন।
তাঁর শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, তাঁর পারিবারিক পরিচয় জিজ্ঞেস না করা, তাঁর মুখের ছবি না তোলা, আরসা নেতৃবৃন্দের পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন না করা এবং তাঁদের প্রশিক্ষণের বিস্তারিত সম্পর্কে জানতে না চাওয়া।
লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা ও ৫০০০ আরসা সদস্যের ভেতর নুরুল ইসলাম নামটি অতি সাধরণ হওয়ার কারণে তাঁর এই প্রকৃত নামটি প্রকাশে কোনো আপত্তি নেই বলে জানান তিনি।
“আরসার শীর্ষ নেতারা ছাড়া মিডিয়াতে কারো কথা বলার অনুমতি নাই। আমি ঝামেলায় পড়তে রাজি না,” বেনারকে বলেন নুরুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত গত মাসে আরসার শীর্ষ নেতা আতাউল্লা আবু জুনুনি সাংবাদিকদের প্রতি এক বিবৃতিতে “আরসার পক্ষে মি. আব্দুল্লা ছাড়া” আর কারো সাক্ষাৎকার নিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
নুরুল জানান “কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়ন থেকে রোহিঙ্গাদের মুক্ত করার জন্য” প্রায় তিন বছর আগে তিনি আরসাতে যোগ দেন।
“তারা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, মা-বোনদের ধর্ষণ করে, আমাদের জমি দখল করে নেয়। কারণ আমরা মুসলিম, তারা আমাদের ডাকে বাঙালি, বলে আমরা বার্মার লোক না। তারা আমাদের ধর্ম পালন করতে দেয় না। তারা অনেক মসজিদ মাদ্রাসা ধ্বংস করে দিয়েছে… আমাদের মানুষগুলারেও,” বলেন নুরুল।
নুরুল জানান, আগে হরকা আল ইয়াকিন নামে পরিচত ও পরে আরসায় রূপান্তরিত সংগঠনটির সদস্যরা বছর তিনেক আগে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে জনসংযোগ শুরু করে। রোহিঙ্গা তরুণদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য মিয়ানমার বাহিনী ও স্থানীয় মগদের বিরুদ্ধে লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করা শুরু করে তাঁরা।
প্রসঙ্গত, রাখাইনে, স্থানীয় বৌদ্ধদের মগ বলা হয়ে থাকে, যারা দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
চলতি বছরের ২৫ আগস্ট ও আগের বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে দুটো আক্রমণেই নুরুল অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানান। আগের বছরের আক্রমণে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নয়জন সদস্য নিহত হয়েছিলেন।
তবে গত আগস্টের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে যে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে, তার রেশে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
'আগস্ট আক্রমণে জড়িত ছিল দেড়শো গেরিলা’
আগস্টের ২৫ তারিখ রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি চৌকিতে একযোগে হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে নুরুল বলেন, “ওই আক্রমণে দেড়শোর মতো গেরিলা অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে ৪২জন ছিল প্রশিক্ষিত। আমরা ভোর রাতে ২৪টি চৌকিতে আক্রমণ করি।”
তবে তিনি জানান আরসার ৫ হাজার সদস্যের সকলেই আক্রমণের জন্য প্রশিক্ষিত নয়। সংগঠনে সদস্যরা “বিভিন্ন ধরনের” দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বলেন, “শারিরীক ও মানসিকভাবে শক্ত তরুণ রোহিঙ্গারাই আক্রমণের জন্য প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।”
মংডুর সেই আক্রমণে তাঁর মতো ১০জন প্রশিক্ষিত ও প্রায় ৫০০জন সাধারণ গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করেন বলেও জানান তিনি।
এক মাস আগে থেকে পরিকল্পনা
“প্রতিটি আরসা কোম্পানিতে বন্দুক ও গ্রেনেডসহ প্রশিক্ষিত গেরিলাদের সাথে লাঠি ও ছোরা নিয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার সাধারণ রোহিঙ্গা থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য আরসার সাথে অনেক লোক আছে এটা দেখিয়ে দলের শক্তি প্রদর্শন,” বেনারকে বলেন নুরুল।
তিনি বলেন, “আরসার কাছে দেশী পিস্তল, রাইফেল আর বোমা রয়েছে।”
যেগুলোর বেশিরভাগই হয় স্থানীয় ডাকাত ও মগদের কাছ থেকে কেনা, না হয় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে লুট করা বলে জানান নুরুল।
তিনি বলেন, “লোকজন যেরকম ভাবে, আমাদের কাছে সেরকম ভারী অস্ত্র নেই,” “আমরা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথেও যুক্ত নই।”
নুরুল জানান একটি পুলিশ ফাঁড়িতে দুইটি বোমা ছুড়ে মেরে তাঁরা ২৫ আগস্টের আক্রমণ সূচনা করেন। এতে পুলিশ গুলি চালানোর আগেই একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে।
তিনি বলেন, “পুলিশ ফাঁড়িটিতে ১৫ জনের মতো ছিল। তারা আমাদের দিকে গুলি ছোড়া শুরু করে। এই গোলাগুলি এক ঘণ্টার মতো চলে। এর পর পুলিশের আরো বড়ো দল এসে পড়লে আমরা পাহাড়ের অন্যপাশে গ্রামে ঢুকে সকাল পর্যন্ত থাকি।”
“আমি পুরা নিশ্চিত না, তবে আমার ধারণা আমরা অন্তত ৫ পুলিশকে হত্যা করেছি। আমাদের দিকে তিনজন আরসা সদস্য ও সাতজন গ্রামবাসী নিহত হয়,” যোগ করেন তিনি।
“পরের দিন আমাদের চর জানায় যে, ওই ঘটনায় ১১ জন মিয়ানমার নিরাপত্তা রক্ষী ও ২৬ জন আরসা সদস্য নিহত হয়েছে। আমি ঠিক জানি না, ওই ঘটনায় মোট কতজন সাধারণ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে,” বলেন নুরুল।
ওই আক্রমণের ঘণ্টাখানেক পরে, মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সুচির দপ্তর থেকে এক বিবিৃতিতে ওই ঘটনায় ১২ জন নিরাপত্তা রক্ষী ও ৫৯ সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়।
২৫ আগস্টের আক্রমণ পরিকল্পনা ‘একমাস আগে’ করা হয়েছিল বলে জানালেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকার করেন তিনি।
“তবে আক্রমণের আগের দিন পর্যন্ত” আক্রমণের তারিখ ও সময় গোপন রাখা হয়েছিল বলে বেনারকে জানান নুরুল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিচালিত দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নির্মূলের আদর্শ উদাহারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা দেশটি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
নুরুল জানান, আগস্টের আক্রমণের সপ্তাহখানেক পর তিনি তাঁর পরিবারের সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
কতজন আরসা সদস্য সীমান্ত পার হয়ে এসে বাংলাদেশে বসবাস করছে, এই প্রশ্নের উত্তরে নুরুল বলেন, “কক্সবাজারে এক থেকে দেড়শো আরসা সদস্য আছে।”
বাংলাদেশ কোনো আরসা নেই: র্যাব
বাংলাদেশে আরসা সদস্য থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব)।
“এখানে আরসার কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই। প্রমাণ ছাড়া আমরা কাউকে আরসার সদস্য বলতে পারি না। যে কেউ যে কোনো কিছু দাবি করতে পারে। আমার জানামতে কক্সবাজারে কোনো আরসা সদস্য নেই,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার র্যাব এর কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন।
চলতি মাসের শুরুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরের সময় দেশটি বাংলাদেশে অবস্থানকারী ৫০০ আরসা সদস্যের নামের একটি তালিকা হস্তান্তর করে তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য বাংলাদেশের সহায়তা চায়।
“আমরা সবোর্চ্চ সতর্ক রয়েছি। বাংলাদেশে কোনো আরসা সদস্য প্রবেশ করা মাত্রই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে,” বলেন মেজর রুহুল আমিন।
‘মুক্তি সংগ্রামী’
নুরুল ইসলামের মতে, আরসার সদস্যরা ‘সন্ত্রাসী নয়, মুক্তি সংগ্রামী।”
“মিয়ানমার সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অনেক বছর নির্যাতন সহ্য করার পর, বাধ্য হয়ে আমাদের মুক্তির জন্য আমরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। আমরা যা চাই তা হলো আমাদের মাতৃভূমি, যেখানে আমরা জন্মেছি, আমাদের বাপ দাদারা জন্মেছে, সেই মিয়ানমারে আমাদের সমান অধিকার।”
“আমরা হয়ত সংখ্যায় কম, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো অত অস্ত্রপাতিও আমাদের নেই, কিন্তু যদি মরতে হয় তবে আমরা ছোরা চাকু ও লাঠি নিয়ে লড়াই করতে করতে মরব। যাতে একদিন আমাদের সন্তানরা মুক্তভাবে নিজের দেশে শ্বাস নিতে পারে,” বলেন নুরুল ইসলাম।