ফিরতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা, শুরু হচ্ছে না প্রত্যাবাসন

কামরান রেজা চৌধুরী ও আবদুর রহমান
2018.11.14
ঢাকা ও কক্সবাজার
181114_rohingya_1000.JPG জোর করে মিয়ানমার পাঠানো হতে পারে এই ভয়ে কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরের নিজের ঘর ছেড়ে পরিবারসহ এক আত্মীয়ের ঘরে আত্মগোপন করেছেন রোহিঙ্গা নারী তৈয়িবা বেগম। ১৪ নভেম্বর ২০১৮।
[রয়টার্স]

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কোনো রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশন এর এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, “ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, কোনো রোহিঙ্গা পরিবারই ফিরে যেতে রাজি নয়। সুতরাং এখন প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে ইচ্ছুক কি না তা যাচাই করার দায়িত্ব জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা “ইউএনএইচসিআর এর।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা শরণার্থী পূনর্বাসন কমিশনারের অফিস থেকে বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না বুধবার রাত পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

প্রত্যাবাসন বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে কি না বেনারের এমন প্রশ্নের জবাব দেননি পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “কাল (বৃহস্পতিবার) নির্ধারিত প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি এ মাসের শেষে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারব।”

এর আগে বুধবার শরণার্থী পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম পয়েন্টে স্থলপথ দিয়েই প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।

তবে ঘুনধুম পয়েন্টে রাত নয়টা পর্যন্ত শরণার্থী পূনর্বাসন কমিশনারের অফিস থেকে কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়া হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন কমান্ডিং অফিসার মনজুরুল আহসান খান।

আবুল কালাম সাংবাদিকদের আরো জানান, ঘুনধুম স্থল সীমান্ত দিয়ে ৩০ পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।

তিনি বলেন, ওই রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যাবে কি না সেটা যাচাই করেছে ইউএনএইচসিআর। তারা বুধবার বিকালে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। কিন্তু প্রতিবেদনে কী বলা হয়েছে সে ব্যাপারে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

জাতিসংঘকে বিশ্বাস করে রোহিঙ্গারা

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশন দপ্তরের এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, ৩০ পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গার সবাই এই মুহূর্তে রাখাইন ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের কথা বিশ্বাস করে। তারা সরকারকে বিশ্বাস করে না।

তিনি বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ এই মুহূর্তে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে, সেহেতু তারা এখন ফিরে যেতে চায় না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাই এখন কিছু মানুষ ফিরে যাক। দু-একদল রোহিঙ্গা ফিরে গেলে বাকিরা যেতে আগ্রহী হবে।

তিনি বলেন, “এ কারণে আমরা কিছু রোহিঙ্গাকে বুঝিয়েছি। তারা ফিরে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। আগামীকাল যদি তাদের পাঠানো যায় তাহলে প্রত্যাবাসন নিয়ে তাদের ভয় কেটে যাবে।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক বেনারকে বলেন, মিয়ানমারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে তাদের ফিরে যাওয়ার পর আমরা রাখাইন সফর করতে পারি।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরার পরিবেশ নেই। তাই সংস্থাটি তাদের ফেরত না পাঠাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমার আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবসান শুরু না হলে এর ব্যর্থতা বাংলাদেশের।

এদিকে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ান বুধবার তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির উপস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় না–ও হতে পারে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, প্রথমে টেকনাফের কেরুনতলী ঘাট দিয়ে নাফনদী পার হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও পরবর্তীতে মিয়ানমারের সাথে আলাপ করে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে।

পরে সিদ্ধান্ত হয়, বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ির ঘুনধুম পয়েন্টে স্থলপথ দিয়েই প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।

এ সময় তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার আমাদের জানিয়েছে, তারা যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের গ্রহণ করতে সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীও উপস্থিত থাকতে পারেন।

আনুষ্ঠানিকতা কী হতে পারে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা এদিক থেকে পাঠাব, তারা ওদিকে থেকে গ্রহণ করবে। এছাড়া ভেরিফিকেশনের কিছু বিষয় আছে। চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।”

নজরদারি বেড়েছে

এদিকে প্রত্যাবাসনকে সামনে রেখে কক্সবাজারের টেকনাফ কেরনতলী (নয়াপাড়া) ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম প্রত্যাবাসন ঘাটে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর রয়েছে।

পাশাপাশি কক্সবাজারের জামতলী, উনচিপ্রাং, চাকমারকুল ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের চলাচলের উপর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানান ওখানকার রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ।

ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে পাঠানো হতে পারে— রোহিঙ্গারা এই ভয়ের মধ্যে আছে বলে মনে করেন তিনি।

এই রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে বলেন, “বুধবার সকাল থেকে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহনীর তৎপরতা দেখে আরও বেশি ভয় পাচ্ছি। সকালে তার ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলাবাহনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি টহল দিয়েছে।”

দিল মোহাম্মদ বলেন, “পুলিশ-বিজিবির তৎপরতায় প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা আত্মগোপনে চলে যাবার কথা ভাবছে। আসলে কাল কী হচ্ছে কিছু জানি না। তবে আমি এখন মিয়ানমারে ফিরব না।”

উনচিপ্রাংয়ের ১৯ রোহিঙ্গা পরিবারের প্রধানের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর এর কর্তা ব্যক্তিরা কথা বলেছেন বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ছব্বির।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে কিনা তা জানতে চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওরা স্পষ্ট করে বলছে, রাখাইনে তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও ভিটেমাটি পাওয়ার নিশ্চয়তা দিলে স্ব-দেশে ফিরবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।