বঙ্গোপসাগর থেকে মালয়েশিয়াগামী ১২২ রোহিঙ্গা উদ্ধার
2019.11.14
কক্সবাজার ও ঢাকা

সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ১২২ জন রোহিঙ্গাবাহী একটি ট্রলার উদ্ধার করেছে বাংলাদেশের কোস্টগার্ড। বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টার দিকে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে তাঁদের আটক করা হয়।
উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১৫ জন শিশু, ৫৯ জন নারী ও ৪৮ জন পুরুষ। উদ্ধারের পর তাঁদেরকে টেকনাফের কোস্ট গার্ড স্টেশনে আনা হয়েছে। তাঁরা সবাই কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন কোস্টগার্ড চট্রগ্রাম জোনের স্টাফ অফিসার লে. কমান্ডার সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় জেলেদের মাধ্যমে খবর পেয়ে কোস্ট গার্ডের একটি দল সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাবাহী ট্রলারটি আটক করে।”
“উদ্ধার রোহিঙ্গারা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন যে, তাঁরা সাগরপথে মালয়েশিয়া যাবার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। তাঁদেরকে এখন নিজ নিজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হবে। এদের মেধ্য চারজন নৌকার মাঝি-মাল্লা। তাঁরাও রোহিঙ্গা,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এই নিয়ে গত দেড় মাসে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাত্রাকালে প্রায় দুইশ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তাঁরা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এছাড়া দুজন দালালকে আটক করা হয়। তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীত মৌসুমকে সামনে রেখে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানব পাচারকারীরা।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, “শীতকালে সমুদ্র শান্ত থাকে বলে মানব পাচারকারীরা এই সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে।”
'উন্নত জীবনের আশায়'
একাধিক শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা জানান, উন্নত জীবনের আশা ও বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছাতেই ভয়ঙ্কর এই পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। বিশ্লেষকরাও রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে একমত।
বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট—রামরুর চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের চেয়ে নিষ্পেষিত জাতি এখন পৃথিবীতে নেই। মিয়ানমার রাখাইন থেকে তাদের বিতাড়িত করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় পেলেও ক্যাম্পের ভেতরে বন্দি শরণার্থী জীবন রোহিঙ্গাদের। একটু ভালো থাকার আশায় মালয়েশিয়া যেতে ভয়ঙ্কর এই পথ বেছে নিচ্ছেন তাঁরা।”
সাগরপথে মানবপাচার বন্ধ করতে পাচারকারী চক্রকে ধরতে সরকারের প্রতি আহবান জানান ড. তাসনীম সিদ্দিকী।
টেকনাফের লেদা ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার বা ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা রোহিঙ্গাদের মধ্যে বরাবরই ছিল। যাদের আত্মীয়-স্বজন বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে, তাঁদের সেদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। এখন সমুদ্র কিছুটা শান্ত, সেই সুযোগে তারা মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল হয়তো।”
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা নুর কালাম বেনারকে বলেন, “সাধারণত মালয়েশিয়া নেওয়ার জন্য রোহিঙ্গা নারীরা পাচারকারীদের টার্গেটে থাকে। প্রথমে ফোনের মাধ্যমে বিদেশে থাকা আত্মীয় স্বজনদের কারো সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে নারীদের রাজি করানো সহজ হয়।”
তিনি বলেন, “আমার শিবির থেকে অনেক রোহিঙ্গা বের হয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও অনেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন কি’না তা আমি নিশ্চিত নই।”
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার বলেন, “শীতের মৌসুম হওয়ায় রোহিঙ্গারা সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। একটি দালাল চক্রও রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় হয়েছে। তবে মানব পাচার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে।”
র্যাব-১৫-এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. মির্জা শাহেদ মাহতাব বেনারকে বলেন, “যেসব দালাল (পাচারকারী) জামিনে বেরিয়ে আসে, তাদের নজরদারিতে রাখছে র্যাব। আর যেসব পাচারকারী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে, তাদের ধরতে র্যাবের একটি বিশেষ টিম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।”
তিনদিন আগে যাত্রা
তিনদিন আগে নৌকাটি কক্সবাজারের উপকূল থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে বলে বেনারকে জানান যাত্রী আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, পথে নৌকাটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা সাগরে ভাসছিলাম।”
মালয়েশিয়াগামী ওই নৌকায় ছিলেন উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যম্পের আই ব্লকের নুর আমিন। তিনি বলেন, “আমার ঘরে চারজন সদস্য রয়েছে। যে ত্রাণ পাই, তা দিয়ে চলতে খুব কষ্ট হয়। সংসারে দুর্দিন দূর করতে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিলাম। কিন্তু কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হয়ে গেলাম।”
মোহাম্মদ আয়াছ নামে নামে আরেক যাত্রী বলেন, “বাংলাদেশে আসার পরে কর্মহীন দিন যাচ্ছে। ঘরে আমি ছাড়া সবাই নারী সদস্য। তিন বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে তাদের বিয়ে দিতে পারছি না।”
“তাদের কথা চিন্তা করে উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে তিন দিন আগে টেকনাফের রাজারছড়া উপকুল থেকে রওনা হয়েছিলাম,” বলেন তিনি।