রোহিঙ্গা সঙ্কট: রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের পক্ষে, ভারত নীরব

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.11.17
ঢাকা
কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরের কাছে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরের কাছে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। ৮ নভেম্বর ২০১৭।
REUTERS

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান বন্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হলেও যথারীতি চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে।

অন্যদিকে মিয়ানমার বা বাংলাদেশ কারো পক্ষ না নিয়ে নীরব থেকেছে ভারত।

বাংলাদেশের সাথে দেশ তিনটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকার পরেও রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো মানাবিক বিষয়ে তাদের নিপীড়নকারী মিয়ানমারের পক্ষাবস্থানের মূল কারণ বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বার্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তৃতীয় কমিটিতে এই ভোটাভুটি হয়। এতে ১৩৫টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। চীন ও রাশিয়াসহ ১০টি দেশ ভোট দেয় প্রস্তাবের বিপক্ষে এবং ভারতসহ ভোটদানে বিরত থাকে ২২টি দেশ।

ভোটাভুটির পর রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেখানে অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমারে প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

ভোটাভুটির মাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটারেস মিয়ানমার বিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়।

সাধারণ পরিষদের এই তৃতীয় কমিটি মানবাধিকার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে থাকে।

সাধারণ পরিষদের অন্য সব সিদ্ধান্তের মতো এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নেও কোনো আইগত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিশ্ব সভার অধিকাংশের মতামত হিসাবে এই প্রস্তাবের নৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

তৃতীয় কমিটির এই এই প্রস্তাবটি পরবর্তীতে সাধারণ সভায় চুড়ান্ত হবার কথা রয়েছে।

মিয়ানমারের পাশে রাশিয়া ও চীন, নীরব ভারত

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন না পাওয়ার মূল কারণ মিয়ামনারের সাথে তাদের অধিকতর ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

“চীন বলুন বা রাশিয়া বলুন সবাই তাদের নিজস্ব স্বার্থকে মাথায় রেখে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অবস্থান নিয়েছে। আসলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের সমর্থন না পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো ভূ-রাজনৈতিক বিষয়,” বেনারকে বলেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মোস্তফা কামাল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “আসলে ১৩৫টি দেশ বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এটি একটি বিশাল ব্যাপার, যদিও চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারকে সমর্থন করেছে এবং ভারত বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কাউকে সমর্থন না করে ভোটদানে বিরত থেকেছে।”

তিনি বলেন, “ফরেন পলিসি হলো একটি ‘নির্মোহ বিষয়’। এখানে সবকিছু আবেগ বা প্রত্যাশা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। স্বার্থ প্রাধান্য পায়।”

ড. দেলোয়ার বলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে আমরা ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করছি। তাদের কাছ থেকে আমরা মিগ-৩৫ কেনার চিন্তা-ভাবনা করছি। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের অস্ত্র কেনার চুক্তি রয়েছে।”

“কিন্তু রাশিয়া জাতিসংঘের থার্ড কমিটির ভোটিংয়ে আমাদের সমর্থন করেনি। তার কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে রাশিয়ার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আমাদের চাইতে অনেক বেশি,” তিনি বলেন।

একইভাবে চীন আমাদের দেশে বছরে দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। তারা আমাদের দেশে পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করছে। এগুলোর অর্থনৈতিক আকার আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার হবে, এই বিশ্লেষক জানান।

“তারপরও চীন থার্ড কমিটিতে আমাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। কারণ, মিয়ানমারের সঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক অনেক গভীর,” একইভাবে ভারত কৌশলগত কারণে আমাদের সমর্থন করেনি। এটি আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক,” বলেন ড. দেলোয়ার।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, ভারত, রাশিয়া ও চীন রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু তারা মিয়ানমারে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে আমাদের সমর্থন করছে না।

“সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উন্নীত হওয়ার পর বিশ্বের সকল দেশ মিয়ানমারে ব্যবসা করতে চায়। সে কারণে, তারা মিয়ানমার সরকারকে খুশি রাখতে চায়। তবে আমরা ছেড়ে দেবো না,” বলেন তিনি।

“ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছে। আমরা তাদের সমর্থন নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখব। আমরা আশাবাদী যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে,” বলেন এই কূটনীতিক।

ঢাকায় আসছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এদিকে থার্ড কমিটির ভোটের একদিন পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। আগামীকাল শনিবার তাঁর ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

এ ছাড়াও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগোট ওয়ালস্ট্রম ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি ফেডেরিকা মগেরিনি শনি-রবিবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ঢাকা আসবেন।

ঢাকা থেকে তাঁরা মিয়ানমারের নেপিদোতে অনুষ্ঠিতব্য আসেম পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দেবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে নেপিদো যাবেন বলে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।