রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেবার পরিকল্পনা বদলাবে না সরকার
2020.11.23
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা অবশ্যই বাতিল করতে হবে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি নাকচ করেছে সরকার।
“সংস্থাটির এই দাবির জন্য সরকারের চিন্তা পরিবর্তন হবে না,” বলে সোমবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
তাঁর মতে, বিষয়টি নিয়ে এমন উদ্বেগের কোনো ভিত্তি নেই।
তবে কবে নাগাদ প্রথম ধাপের রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেয়া হবে সেই তারিখ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সরকার।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে সেখানে কোনো রোহিঙ্গা স্থানান্তর হয়নি। তবে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে যাবার জন্য প্রথম ধাপে প্রায় তিনশ রোহিঙ্গা পরিবার রাজি হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন সরকারের কর্মকর্তারা।
এদিকে গত ২০ নভেম্বর এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, জাতিসংঘের মতে ভাসানচর এখনও মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়।
প্রথম ধাপে যেসব রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাঁদের আংশিক তালিকা সংস্থাটির কাছে রয়েছে দাবি করে অ্যামনেস্টি জানায়, বর্তমানে ভাসানচরে থাকা তিনশ’র বেশি রোহিঙ্গা খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছেন।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে গত মে মাসে দুই দফায় নারী-শিশুসহ মোট ৩০৬ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সঙ্গনিরোধে রাখার কথা বলে সরকার তাঁদেরকে ভাসানচরে নিয়ে যায়।
ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আসার জন্য সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা অনশন ধর্মঘটও করেন গত সেপ্টেম্বরে।
এদিকে ওইসব রোহিঙ্গা ভাসানচরে থাকতে না চাওয়ার প্রেক্ষিতে তাঁদেরকে কক্সবাজারের নিয়ে আসার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে গত ১৩ নভেম্বর বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা বিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন।
যদিও এখন পর্যন্ত এর কোনো তারিখ ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
‘বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন’
শরণার্থীদের স্থানান্তরের জন্য ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা বসবাসের উপযোগী কি না তা দেখাতে গত সেপ্টেম্বরে সেখানে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার।
সরফরকারী রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচরের সৌন্দর্য ও স্থাপনা দেখে খুশি হলেও “দ্বীপটি বসবাস উপযোগী কিনা সে বিষয়ে কোনো মতামত দিতে পারছেন না” বলে বেনারকে জানান আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়নের সেক্রেটারি মাস্টার মো. ইলিয়াছ।
“তাই এ বিষয় যারা বিশেষজ্ঞ আছে তাঁদের মতামত নিতে হবে,” জানিয়ে ইলিয়াছ বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামত নিয়েই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া উচিত।
তাঁর মতে, “কাউকে জোর করে ভাসানচরে রাখা উচিত হবে না। কাউকে জোর করে নিয়ে যাওয়াটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
“কেউ স্বেচ্ছায় ওই দ্বীপে যেতে চাইলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যারা ওই দ্বীপে থাকতে চাইছে না তাদের দ্রুত নিয়ে আসা হোক,” বলেন ইলিয়াছ।
সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি শরণার্থীদের “জীবিকার জন্য সেখানে নানা ধরনের উদ্যেগ’ নেওয়া হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।
ভাসানচরে যেতে তালিকাভুক্তির জন্য সরকার শরণার্থীদের চাপ প্রয়োগ করেছে’ অ্যামনেস্টি’র এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন “কাউকেই সেখানে জোর করে পাঠানো হবে না।”
‘চাপ প্রয়োগের অভিযোগ’
ভাসানচর যেতে আগ্রহী তালিকাভুক্ত কিছু রোহিঙ্গার সাথে কথা বলার দাবি করে অ্যামনেস্টি জানায়, সরকারি কর্মকর্তারা ভাসানচর যেতে শরণার্থীদের চাপ প্রয়োগ করেছেন।
অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অনুবিভাগের প্রধান ওমর ওয়ারাইচ বিবৃতিতে বলেন, “অনেক রোহিঙ্গা যাদের সাথে আমরা কথা বলেছি তাঁরা সেখান যাওয়ার জন্য সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ণ সম্মতি দেননি। কারণ তাঁরা এই দ্বীপ সম্পর্কে কিছু জানেন না।”
ভাসানচের যেতে আগ্রহী হিসেবে তালিকাভুক্ত এক রোহিঙ্গা নারী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানান, তিনি ভাসানচরে যেতে সম্মতি দিয়েছেন কারণ তাঁর স্বামী সেখানে রয়েছেন। স্বামী ছাড়া ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে শরণার্থী শিবিরে তিনি বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
“আমার কাছে অন্য কোনো পথ খেলা নেই। মনে হচ্ছে সরকার আমার স্বামীকে আর কোনোদিনও ওই দ্বীপ থেকে আসতে দেবে না,” বলেন ওই নারী।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী অন্য দুই পরিবারের সদস্যরা অ্যামনেস্টিকে জানান, ঘর ভেঙে যাওয়ায় মেরামতের জন্য তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা ও সেখানকার রোহিঙ্গা নেতাদের জানিয়েছিলেন। জবাবে তাঁরা বলেছেন, ভালো ঘর পেতে হলে ভাসানচর যেতে হবে।
অন্য একটি পরিবার প্রধান জানান, ঘর মেরামতের জন্য বেসরকারি সংগঠন ও শিবিরের কর্মকর্তাদের কাছে কয়েকদফা যোগাযোগ করছেন তিনি।
এর উত্তরে শিবিরের সরকার নির্ধারিত নেতা (মাঝি) তাঁকে জানান, ভাসানচরে গেলে, পরিবারের জোগান ও তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসা বাবদ তাঁর যে ঋণ তা পরিশোধ করে দেয়া হবে।
“এ জন্য আমি যেতে রাজি হয়েছি। কারণ আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই,” বলেন তিনি।
ওমর ওয়ারাইচ বলেন, অ্যামনেস্টি যাদের সাথে কথা বলেছে তাঁরা জানিয়েছেন, ভাসানচরে যেতে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাঁরা স্বেচ্ছায় নয় বরং চাপে পড়ে যেতে রাজি হয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানান্তর কার্যক্রম শুরুর দাবি করে তিনি বলেন, “বর্তমানে সেখানে যারা বসবাস করছে তাঁদের কক্সবাজারে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ভাসানচর বসবাসযোগ্য কি না এ ব্যাপারে পরর্বতী সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দিতে হবে।”
ভাসানচরের প্রকৃত অবস্থা জানতে মানবাধিকার সংগঠন ও মানবিক সহয়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে বাধাহীন প্রবেশাধিকার দিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে ভাসানচর পরিদর্শনে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনা চলছে বলে এর আগে বেনারকে জানিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন।
‘দ্বীপে যেতে চাই না’
উখিয়ার কুতুপালং এর মো. আইয়ুব আলীর স্ত্রী সোফাইদা বেগম বেনারকে জানান, তাঁর বাবা-মা, দুই ভাই ও এক বোন মালয়েশিয়ায় থাকেন। বর্তমানে তাঁর ছোট এক ভাই ও এক বোন রয়েছে ভাসানচরে।
তিনি বলেন, “বাবা-মায়ের কাছে যেতে গিয়ে তারা এখন ভাসানচরে আটকে আছে। তাদের জন্য বাবা- মা খুব দুশ্চিন্তা করছে। সাগরের মাঝখানে বসবাস করা নিরাপদ মনে করছে না। আমি চাই, আমার ভাই বোনদের দ্রুত এখানে নিয়ে আসা হোক।”
“জীবন বাঁচানোর জন্য মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছি। মরলে এখানে মরব। তবুও ওই দ্বীপে যেতে চাই না,” বলেন সোফাইদা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভাসানচরে।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।