কক্সবাজার: দুই বছরে শনাক্ত ৩৯৫ রোহিঙ্গা এইডস রোগী
2019.12.02
কক্সবাজার

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে উপকূলীয় সীমান্তের জেলা কক্সবাজারে চিহ্নিত এইডস রোগীর সংখ্যা মাত্র দুই বছরে বেড়েছে চারগুণ। ২০১৭ সালের অক্টোবরেও পুরো জেলায় আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ১৩২ জন, গত নভেম্বর শেষে যা দাঁড়িয়েছে ৫৩৮ জনে, যার মধ্যে ৩৯৫ জনই রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের এইচআইভি ট্রিটমেন্ট সেন্টারের মুখপাত্র ডা. শাহীন আব্দুর রহমান সোমবার বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করে জানান, এই সময়ে জেলায় ২৯ রোহিঙ্গাসহ মোট ৭২ জন চিহ্নিত এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেছেন।
কক্সবাজারে ৩৪৫ জন রোহিঙ্গাসহ মোট মধ্যে ৪২৮ জন এইডস রোগী নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন বলেও জানান ডা. শাহীন।
“রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসে (এইচআইভি) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়েছে,” যোগ করেন সদর হাসপাতালের এই আবাসিক কর্মকর্তা।
‘প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি’
“রোহিঙ্গাদের এইডস আক্রান্তের হার আমাদের তুলনায় বেশি,” উল্লেখ করে রোববার ঢাকায় বিশ্ব এইডস দিবসের আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল মতিন বেনারকে বলেন, “যেসব রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে এসেছেন, কেবল তাঁদেরকেই শনাক্ত করা গেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোয় বসবাসকারী এইডস রোগীর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।
মিয়ানমারে এইচআইভি আক্রান্তের হার দশমিক শূন্য আট শতাংশ জানিয়ে ডা. শাহীনও বলেন, “তাদের দেশের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলেও কক্সবাজারে অবস্থানকারী প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আরো অনেক এইডস রোগী থাকার কথা।”
এদিকে বাংলাদেশে এইডস রোগীর হার দশমিক শূন্য এক শতাংশ বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
জাতীয় এইডস এবং এসটিডি (যৌনবাহিত রোগ) প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম রোববারের ওই সভায় জানান, চলতি বছর সারাদেশে ৯১৯ জন নতুন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১০৫ জন।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সারা দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৬৯ জন।
শঙ্কায় উন্নয়ন কর্মী-চিকিৎসকরা
কক্সবাজারে এইডস প্রতিরোধে সক্রিয় বেসরকারি সংস্থা এক্সপাউরুলের নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী কানন পাল বেনারকে জানান, “জেলার উখিয়া উপজেলায় ১৯৯২-৯৩ সালে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে থাকতেন।”
“এরপর নিয়মিত কিছু এইডস রোগী শনাক্ত করা হলেও রোহিঙ্গারা আসার পর এর হার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এই জেলায় এটা মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে।”
তবে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের পরামর্শক ডা. বিধান পাল দাবি করেন, “এইডসকে আগে যেভাবে দেখা হতো, এখন কিন্তু সেভাবে দেখা হচ্ছে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।”
“কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ এতটাই বেশি যে তাদের যদি একটা নিয়মের মধ্যে না রাখা যায় তাহলে মহাবিপদ ঘটতে পারে,” বেনারকে বলেন তিনি।
উন্নয়ন কর্মী ও চিকিৎসকদের দাবি, প্রশাসনের নজরদারির পরও অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছেন।
বর্তমানে অজস্র রোহিঙ্গা কিশোরী-যুবতী স্থানীয়দের বাসা ও প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশি বিয়েও করছেন তাঁদের।
“এছাড়া পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত রোহিঙ্গা নারীদের কারণেও এইডস ছড়িয়ে পড়তে পারে,” শঙ্কা কানন পালের।
চলছে প্রতিরোধের নানা চেষ্টা
কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য় বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস যাতে দ্রুত বিস্তার না ঘটতে পারে সেজন্য প্রথমত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।”
“অরক্ষিতভাবে যৌন মিলন না করা, অর্থাৎ পুরুষদের অবশ্যই কনডম ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজ করে। তারা জন্মনিয়ন্ত্রনের কোনো পদ্ধতি ব্যবহারে মোটেও আগ্রহী নয়।”
“কাউন্সেলিং করার কারণে বর্তমানে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে,” যোগ করেন ডা. পিন্টু।
সিভিল সার্জন ডা. মতিন জানান, শরণার্থী অধ্যুষিত উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় এইডস প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ১২টি দল কাজ করছে।
এছাড়া ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থার (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় সদর হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি প্রকল্প চালু করা হয়।
“এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের সন্তান যেন সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ করে হয়, সেটাই লক্ষ্য এই প্রকল্পের,” বলেন এইচআইভি ট্রিটমেন্ট সেন্টারের ডা. শাহীন।
এর অধীনে এ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪৭১ জন গর্ভবতী নারীর এইচআইভি পরীক্ষা করে ২৯ জন এইডস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু এবং বাকি ২৮ জনের সন্তান প্রসব হয়েছে।
“যার মধ্যে মাত্র দুইটি শিশু মাতৃরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এই হিসাবে প্রকল্পটি সফল বলাই যেতে পারে,” বলেন ডা. শাহীন।
৩০ বছরে মারা গেছেন সহস্রাধিক
“১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশে এইডস আক্রান্ত হয়েছেন সাত হাজার ৩৭৪ জন। এর মধ্যে এক হাজার ৩৪২ জন মারা গেছেন,” বলেন এ বিষয়ক জাতীয় প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামিউল।
তাঁর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর ২৭ হাজার ১৬৮ জন সাধারণ মানুষের এইডস ‘টেস্টিং’ ও ৪১ হাজার ৩০৯ জনের ‘স্ক্রিনিং’ করা হয়েছে। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ পুরুষ, ২৫ শতাংশ ও এক শতাংশ তৃতীয়লিঙ্গের। যাদের প্রায় ৭৫ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৪৯ বছর।
নতুন রোগীদের ৫৮৭ জন বিবাহিত, ১৭৫ জন অবিবাহিত, ১৭ জন তালাকপ্রাপ্ত, ১০ জন বিধবা ও চারজন ভিন্ন যৌনাচারের ছিলেন। যার মধ্যে ১৭০ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন বলেও উল্লেখ করেন ডা. শামিউল।
তাঁর দাবি, দেশে আনুমানিক ১৪ হাজার এইডস রোগী রয়েছেন।
২০৩০ সালের মধ্যে এইডস নির্মূলের আশাবাদ ব্যক্ত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “এইডস রোগীদের ওষুধ দেওয়ার যে হার, তাতে বিশ্বমানের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। তবে আমরা এতে সন্তুষ্ট না, পরিধি আরো বাড়াতে হবে।”
“এইডস রোগীদের ত্যাগ না করে চিকিৎসা করাতে হবে,” বলেন তিনি।
ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।