ভাসানচরে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা, জাতিসংঘ অবগত নয়
2020.12.02
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তরের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ হলেও জাতিসংঘকে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি, এমনকি এ বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলেও অভিযোগ করেছে সংস্থাটি।
এদিকে বৃহস্পতিবার থেকেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হতে পারে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সরকারেরর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গারা।
বুধবার বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।
“…স্থানান্তরের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অথবা শরণার্থীদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই,” বলা হয় বিবৃতিতে।
ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন প্রাসঙ্গিক, নির্ভুল এবং হালনাগাদ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তা নিশ্চিতের আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের আগে ভাসানচরের সার্বিক সুরক্ষা বিষয়ক একটি প্রায়োগিক মূল্যায়ন (টেকনিক্যাল প্রোটেকশন এসেসমেন্ট) করার জন্য বারবার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ। তবে এখনো অনুমতি দেয়নি সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে, জাতিসংঘ প্রায়োগিক এবং সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এই নিরপেক্ষ মূল্যায়নে শরণার্থীদের বাসস্থান হিসেবে ভাসানচরের নিরাপত্তা, প্রায়োগিক সম্ভাব্যতা, স্থায়িত্ব এবং সুরক্ষা কাঠামো এবং তাঁদের সহায়তা ও সেবা-গ্রহণের অবকাঠামোর সার্বিক পর্যালোচনা করা হবে।”
বাংলাদেশ সরকার এই দাবির বিষয়ে অবগত থাকলেও “জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের ভাসানচরে যেতে কবে অনুমতি দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি,” বলে বুধবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মো. খুরশেদ আলম।
“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যে কক্সবাজারের যেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা আছে সেটা খুব ভালো পরিবেশ না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার নিজের খরচে রোহিঙ্গাদের ভালোভাবে থাকার জন্য ভাসানচরে যে ব্যবস্থা করেছে, তা ‘নজিরবিহীন।’
রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে গেলে এবং জাতিসংঘের আপত্তি না থাকলে এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও কোনো আপত্তি নেই বলে বুধবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ইউরোপের ছয় রাষ্ট্রদূত।
ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে তিরিংক বলেন, “ভাসানচরের বিষয়ে জাতিসংঘের টেকনিক্যাল কমিটি মূল্যায়ন না করা পর্যন্ত সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে আগাম মন্তব্য করবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।”
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে বলেও জানান নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারওয়াজ।
স্থানান্তর শুরু হতে পারে বৃহস্পতিবার
বৃহস্পতিবার থেকেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হচ্ছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন সরকারেরর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গারা।
“ডিসেম্বরের ৩ অথবা ৪ তারিখে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কথা রয়েছে,” বেনারকে বলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, “কক্সবাজারের শরণার্থীশিবির থেকে প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তর করা হতে পারে। ফলে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য কর্মকর্তাসহ এপিবিএনের ২২২ জন সদস্যকে নতুন করে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে।”
বর্তমানে ভাসানচরে এপিবিএনের ৩০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন বলেও জানান মোশাররফ হোসেন।
“গত রোববারও সরকারের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর পরিদর্শনে করেছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই স্বেচ্ছায় যেতে চাওয়া রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে,” বুধবার বেনারকে বলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা।
‘স্থানান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না’
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে “রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের নাগরিক নয়। আবার তাঁদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনও শুরু হচ্ছে না,” মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান এহসানুল হক বেনারকে বলেন, এ অবস্থায় কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শিবিরগুলো থেকে চাপ কমানোর জন্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত “অবশ্যই ইতিবাচক।”
জাতিসংঘের বিরোধিতার প্রসঙ্গে এহসানুল হক বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং অধিকার আছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা শোভনীয় নয়। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের চেয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলোকে ভূমিকা রাখার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।”
এদিকে বুধবার পরারাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বসবাসের বিষয়ে না ভেবে জাতিসংঘের উচিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির উন্নতির দিকে নজর দেওয়া। যাতে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ তৈরি হয়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন কারণে ভাসানচরের পরিবেশ রোহিঙ্গাদের বসবাসের উপযুক্ত কিনা তা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের আগে সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য বুধবার এক বিবৃতিতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল।
তবে ভাসানচরের পরিবেশ ভালো কি মন্দ সে বিষয়ে সরকারের পরিস্কার ধারণা আছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “যে যাই বলুক, স্থানান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না।”
ভালো থাকার আশায় যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা
ভাসানচরে যেতে নাম লিখিয়েছেন টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা শারমিন আক্তার (২০)।
তিনি বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার আমাদের ভাসানচরে নেওয়া হবে জানিয়ে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আমাদের প্রস্তুতি শেষ। আমরা আগে থেকে ঘরসহ সকল পুরনো আসবাব বিক্রি করে দিয়েছি।”
“মাঝিদের (নেতা) কাছে শুনেছি, কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে চরে জীবন উন্নত, তাই সেখানে যেতে রাজি হয়েছি। সেখানে আমাদের থাকার জন্য ঘরসহ চাষবাদ করতে জমিজমা দেবার কথা বলেছেন তাঁরা। যাওয়ার বেলায় জনপ্রতি খরচ হিসেবে ১০ হাজার টাকা দেবে বলেছে,” বলেন তিনি।
“আমরা সেখানে যাওয়ার পর ভালো লাগলে আত্মীয়-স্বজনরাও যেতে রাজি হবেন,” বলেন শারমিন।
যদিও সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের টাকা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি। এমনকি বিভিন্ন ক্যাম্পের অন্তত তিনজন মাঝির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের অন্য এক বাসিন্দা সালামত উল্লাহ জানান, বুধবারই তাঁর পরিবার শিবির থেকে বের হবে। ভাসানচরে যাবার সিন্ধান্ত নেবার পর, তিনিও তাঁর ঘরের সব পুরোনো মালপত্র বিক্রি করে দিয়েছেন।
সালামত বলেন, “এখানে কষ্টের জীবন কাটাচ্ছি। তাই উন্নত জীবনের আশায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সেখানে চলে যাচ্ছি, জানি না ভাগ্যে কী আছে।”
“শুনেছি আমাদের এখান থেকে উখিয়া ট্রানজিট পয়ন্টে নিয়ে যাবে। পরে সেখান থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে,” জানান সালামত।
এদিকে বুধবার দুপুরেই শামলাপুর শিবিরের দুই পরিবার উখিয়ায় রওয়ানা দিয়েছেন বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতা মো. এনামুল্লাহ। তিনি জানান, উখিয়ায় তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হবে।
“এখানকার চেয়ে দ্বিগুন ত্রাণ, সন্তানদের শিক্ষাসহ নানা সুযোগের প্রতিশ্রুতিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছি। তা ছাড়া ভাসানচর থেকে এখানেও আসা যাওয়া করা যাবে বলে মাঝিরা জানিয়েছেন,” বেনারকে বলেন অন্য এক রোহিঙ্গা শরণার্থী মো. হাসান।
ভাসানচর প্রস্তুত
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন এনজিও থেকে পাওয়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সেখানে পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার থেকে আংশিক রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভাসানচরে।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে শুরু থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আপত্তি জানিয়ে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতাদের ভাসানচরে নিয়ে সেখানে নির্মিত অবকাঠামোসহ আবাসন পরিস্থিতি ঘুরে দেখানো হয়।
বর্তমানে সেখানে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যারা সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে গত মে মাসে ফিরে এসেছিলেন।
“ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিবারের অনেকেই কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে বসবাস করছে। এ কারণে তাদেরকে কক্সবাজারে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কবে ফেরানো হবে সেটা নির্ভর করছে নতুন রোঙ্গিাদের ভাসানচরে নেওয়ার ওপর,” জানান মেরিটাইম সচিব খুরশেদ আলম।