রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা অধিকার বঞ্চিত করছে বাংলাদেশ: এইচআরডব্লিউ

শরীফ খিয়াম
2019.12.03
ঢাকা
191203_Rohingya_eduction_HRW_1000.jpg কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী কয়েকজন রোহিঙ্গা শিশু। ২২ আগস্ট ২০১৮।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় অর্থবহ শিক্ষার সুযোগ তৈরির কাজে দাতাগোষ্ঠীকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। শিবিরের বাইরের বিদ্যালয়গুলোয় শরণার্থী শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা হয়েছে। এমন অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

“সরকারের দ্রুত এ জাতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া উচিত, যা প্রায় চার লাখ শরণার্থী শিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে অবৈধভাবে বঞ্চিত করছে,” মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে সংস্থাটি।

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মো. এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, “শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে আমাদের। অবৈধভাবে কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে না বাংলাদেশ।”

“তবে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী কাউকে আমাদের বিদ্যালয়ে বা পাঠ্যক্রমে পড়তে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই,” বলেন তিনি।

‘আমরা কি মানুষ নই?: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জন্য শিক্ষা সুযোগ অস্বীকার’ শিরোনামে প্রকাশিত ৮১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিশুদের স্বীকৃত বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানে বাংলাদেশ কীভাবে বাধা দিচ্ছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

এইচআরডব্লিউ ১৬৩ জন রোহিঙ্গা শিশু, অভিভাবক, শিক্ষক, সরকারি ও মানবিক সহায়তা সংস্থা ও জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের নীতি ও ত্রাণ-সহায়তা পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করে দেখেছে।

সরকারের বিধি-নিষেধের মধ্যে থেকেও ত্রাণ-সহায়তা সংস্থাগুলো শরণার্থীশিবিরে কীভাবে শিশু শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছে, সেটাও গবেষণার কথা জানিয়েছে তারা।

যদিও বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, “এটি একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিবেদন। প্রতিটি কাজেই আমরা দাতা সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছি।”

“৮১ পৃষ্ঠা কেন, ৮১ হাজার পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়েও এইচআরডব্লিউ প্রমাণ করতে পারবে না যে বাংলাদেশ অবৈধ কিছু করছে,” বলেন সরকারের এই যুগ্ম-সচিব।

অন্যদিকে প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এইচআরডব্লিউর শিশু অধিকার বিভাগের সহযোগী পরিচালক বিল ভ্যান এসভেল্ড দাবি করেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুরা তাদের শিক্ষা ও উন্নত ভবিষ্যতের সুযোগ কর্পূরের মতো উবে যেতে দেখছে। দুই বছর পরেও তাদের স্কুল নেওয়ার জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই।”

“রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত করার ভুল নীতি থেকে বাংলাদেশকে সরে আসতে হবে,” বলেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী এনামুর বলেন, “আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের বঞ্চিত করতে চাই না। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী তাদের শিক্ষার বিষয়টি দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানবিক সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি আমরা।”

তিনি বলেন, “আমরা সব সময়ই চেয়েছি রোহিঙ্গারা দ্রুত নিজেদের দেশে ফিরে যাক। তবুও তাদের আশ্রয়, স্যানিটেশন, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ প্রতিটি সুবিধাই আমরা সুনিশ্চিত করেছি। কিন্তু তাদেরকে আমাদের দেশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাক্রমে ঢুকতে দেওয়ার সুযোগ নেই।”

“দাতাগোষ্ঠীরা চাইলে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ব্যবহার করতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। রোহিঙ্গা শিবিরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এটাই বরং একটি ভালো সমাধান হতে পারে। কারণ তারা মিয়ানমারেরই নাগরিক,” বলেন তিনি।

এইচআরডব্লিউ বলছে, মিয়ানমারের অবিলম্বে তাদের পাঠ্যক্রম শরণার্থীশিবিরে ব্যবহারের অনুমোদন ও এই বিষয়ে সহায়তা দেওয়া উচিত। বাংলাদেশেরও উচিত দাতাগোষ্ঠীগুলোকে আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমসহ মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের সুযোগ করে দেয়া।

শরণার্থীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক মো. ছৈয়দ আলম বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে এখানকার শিক্ষাকে যেন কাজে লাগানো যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। ক্যাম্পের ভেতরে মিয়ানমার কারিকুলামে অন্তত দশম শ্রেণির শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।”

“যথাযথ শিক্ষার অভাবে শরণার্থী শিশুদের অনেকেই অপরাধমূলক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যেতে পারে,” বলেন তিনি। এ ব্যাপারে এইচআরডব্লিউর বক্তব্য, শিক্ষিত শরণার্থী শিশুর অপরাধ বা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হবার সম্ভাবনা কম।

তারা মনে করে, শরণার্থীশিবিরে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী সেদেশের সাবেক শিক্ষকদের সাথে দাতাগোষ্ঠীগুলোর নিবিড়ভাবে কাজ করা উচিত।

“সম্পূর্ণ একটি প্রজন্মকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা কারো স্বার্থই রক্ষা করে না, এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নীতি পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোকে দাবি উত্থাপন ও এই বিষয়ে কাজ করে যেতে হবে,” বলেন ভ্যান এসভেল্ড।

এদিকে শিক্ষাবঞ্চিত শরণার্থী শিশুরা ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদীদের সহজ শিকারে পরিণত হতে পারে বলে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিার কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শরণার্থী শিবিরের তরুণ রোহিঙ্গা নেতা খিন মঙ।

তিনি বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এইসব শিশুরা তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ছে। আর হতাশার ফলে, তারা সহজেই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোর সাথে ভিড়ে যাবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যা সারা বিশ্বের জন্যই বিপজ্জনক।”

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রে রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদান করছেন শিক্ষক। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রে রোহিঙ্গা শিশুদের পাঠদান করছেন শিক্ষক। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

উদ্বিগ্ন রোহিঙ্গা অভিভাবক

সংস্থাটিকে শরণার্থীরা বলেছেন, শিবিরের মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া আর কিছুই শেখানো হয় না।

শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে রোহিঙ্গা অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থীশিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নূরও বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের বাইরের স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ দেওয়া না গেলে ক্যাম্পের ভেতরে যে স্কুলগুলো আছে, সেগুলোয় অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হোক।”

এইচআরডব্লিউ বলছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কয়েক প্রজন্মকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও কখনোই তাদের শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর পালিয়ে আসা নতুন সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গার শরণার্থীশিবিরে অনানুষ্ঠানিকভাবেও বাংলাদেশি পাঠ্যক্রম অনুসরণ নিষিদ্ধ করা হয়।

মিয়ানমারও শরণার্থীশিবিরে তাদের পাঠ্যক্রম ব্যবহারের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যে কারণে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) একটি অনানুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম তৈরি করে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিষয়ক বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে তৈরি করা ওই পাঠ্যক্রম ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সরকারের অনুমোদনের জন্য জমা দেয়া হয়। এরপর কিন্তু প্রাক-বিদ্যালয় ও প্রাথমিকের সমমানের শিক্ষার দুইটি স্তর অনুমোদনের জন্য ঢাকা এক বছর সময় নেয়।

অনানুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের উচ্চতর তিনটি স্তর সরকার এখনো অনুমোদন করেনি বলেও উল্লেখ করেছে এইচআরডব্লিউ।

প্রতিমন্ত্রী এনামুর বেনারকে জানান, এ নিয়ে কাজ চলছে।

বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা

শিশু অধিকারসহ অন্যান্য মানবাধিকার বিষয়ক সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশে সব শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য। এছাড়া ২০১৮ সালের বৈশ্বিক শরণার্থী চুক্তি সাক্ষর করেছে বাংলাদেশ, যেখানে শরণার্থী শিশুদের জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতায় আনতে বলেছে।

ওই চুক্তি স্বাক্ষারকারী সব সরকার ও জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ অঙ্গীকার করেছিল, শরণার্থী শিশুরা স্থানান্তরিত হবার তিন মাসের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে বেআইনি বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে তারা চাপ দেয়নি।

শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দুই দফা প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, কাঠামোগত শিক্ষার অভাব পূরণে অনানুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তবে রোহিঙ্গা শিশুদের বৈষম্যহীনভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতার দিক বিবেচনায় এটা খুবই অপ্রতুল।

কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।