আন্তর্জাতিক আপত্তি সত্ত্বেও ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু
2020.12.03
ঢাকা ও কক্সবাজার

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করেছে সরকার, প্রায় দেড় হাজার জনের প্রথম দলটি শুক্রবার দুপুর নাগাদ ওই দ্বীপে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোশারফ হোসেন বেনারকে জানান, রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে সড়কপথে চট্টগ্রামে পৌঁছে বৃহস্পতিবার রাতে সেখানেই থাকবেন। শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে করে দুপুর নাগাদ ভাসানচর পৌঁছাবেন।
“প্রথম দফায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গার ভাসানচরে যাওয়ার কথা ছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে শেষ পর্যন্ত কতজন সেখানে যাচ্ছে, সেটা পরে জানা যাবে।”
এদিকে বৃহস্পতিবার ৪২টি বাসে করে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক এক হাজার ৫০১ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচর নেবার উদ্দেশ্যে চট্রগ্রামে পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যুক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা।
ওই রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা।
তবে বাস ও রোহিঙ্গার সংখ্যা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা।
“রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে ভাসানচরে সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান।
প্রসঙ্গত, ভাসানচর নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল যে, একটি দেশ অন্য একটি দেশের নাগরিকদের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করে থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে তারা ভালো থাকলে তা সবার জন্যই ভালো।”
“আন্তর্জাতিক মহল যদি সত্যিকার অর্থেই রোহিঙ্গাদের স্বার্থ দেখতে চায়, তাহলে ভাসানচরে পাঠানোকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আরো বেশি শক্ত অবস্থান, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করা উচিত,” বলেন ড. দেলোয়ার হোসেন।
আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনা
বন্যাসহ প্রাকৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করায় আন্তর্জাতিক সমালোচনা জোরদার হয়েছে।
প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিনেই তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফোর্টিফাই রাইটস।
বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি স্বচ্ছ স্থানান্তর প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শরণার্থীদের বুঝে-শুনে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এবং ভাসানচরে যাওয়া-আসার অনুমতি সাপেক্ষে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “সরকার দ্বীপটির বাসযোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হলে এ ব্যাপারে তাঁদের স্বচ্ছ হওয়া উচিত।”
অ্যামনেস্টির মতে, দুর্গম ওই দ্বীপটিতে মানবাধিকার গ্রুপ ও সাংবাদিকদের আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির স্বাধীন পর্যবেক্ষণও হুমকির মুখে পড়বে।
“সব ধরনের মানবাধিকার এবং মানবিক উদ্বেগ নিরসনের আগ পর্যন্ত এবং প্রকৃত তথ্যভিত্তিক সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত একজন শরণার্থীকেও সেখানে স্থানান্তর করা উচিত নয়,” বিবৃতিতে বলেন ফোর্টিফাই রাইটসের আঞ্চলিক পরিচালক ইসমাইল ওলফ।
এর আগে বুধবার এক বিবৃতিতে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় জানায়, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যও নেই বলে জানায় সংস্থাটি।
জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তির জবাবে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “ভাসানচরে কাউকে জোর করে নেয়া হচ্ছে না। যারা সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, কেবল তাঁদেরই স্থানান্তর করা হচ্ছে।”
“রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর কারণে কক্সবাজারের পাহাড়, গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে। দিনে দিনে মাদক ও মানবপাচারের মতো অপরাধের সাথে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে। এসব বন্ধে এবং একটু ভালো জীবন দিতেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।
ড. মোমেন জাতিসংঘের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য গত তিন বছরে রাখাইনে কী ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো অ্যাসেসমেন্ট জাতিসংঘ করেছে কি না?”
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাবার বিষয়ে জাতিসংঘের যে উদ্বেগ তা মিয়ানমারকে জানানোর পরামর্শ দিয়ে ড. মোমেন বলেন, “স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রথম দিন থেকেই পুরো প্রক্রিয়া বারবার জাতিসংঘকে জানানো হয়েছে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আপত্তির জবাবে ড. মোমেন আরো বলেন, “ইংল্যান্ড বা আমেরিকা কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়ে গেলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”

কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গারা
বুধবারেই ভাসানচর যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় এনে কক্সবাজারের উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট ও কলেজের অস্থায়ী ট্রানজিট ঘাটে রাখা হয়।
বৃহস্পতিবার সেখানে উপস্থিত ছিলেন দুজন বেনার প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১ টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একে একে ৪২টি বাস কক্সবজারের উখিয়া কলেজ গেট থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এসব বাসে ‘চল চল ভাসানচর চল’ নামে স্টিকার লাগানো ছিল। রোহিঙ্গারা জানান, ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পরে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতসহ একাধিক কর্মকর্তার সাথে বারবার যোগাযোগ করলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি।
বেদনার্ত পরিবেশ
সরেজমিন দেখা যায়, ভাসানচরগামী রোহিঙ্গাদের বিদায় জানাতে ট্রানজিট ক্যাম্পের আশেপাশে ভিড় করেন তাঁদের স্বজনেরা।
দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে ছেলে ওমর হামজাসহ তাঁর পরিবারের পাচঁ সদস্যকে বিদায় জানান রোহিঙ্গা নারী রহিমা খাতুন(৬০)।
পরে আবেগাপ্লুত রহিমা খাতুন বেনারকে বলেন, “ছেলে পরিবার নিয়ে ভাসানচরে চলে যাচ্ছে। এই বিদায় খুব কষ্টের। জানি না ছেলেকে আবার কবে দেখতে পাব।”
“তবে আশা করছি এখানকার চেয়ে ভাসানচরে পরিবার নিয়ে সে ভালো থাকবে। তারা ভালো থাকলে আমিও যাওয়ার বিষয়ে ভাবব,” বলেন তিনি।
কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্টে দাঁড়িয়ে কথা হয় মো. তৈয়ুব নামের আরেক রোহিঙ্গার সাথে। উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এই বাসিন্দা বেনারকে বলেন, “এখানে খুব কষ্টে আছি, তাই স্বেচ্ছায় এক সপ্তাহে আগে স্ত্রী-সন্তানসহ ভাসানচরে যাওয়ার তালিকায় নাম দিয়েছি। যেতে ভালো লাগছে, তবে একটু ভয়ও কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “নতুন জায়গা কেমন হবে বুঝে উঠতে পারছি না। তবে আশা করছি অন্তত সেখানে সন্তানদের উন্নত জীবন দিতে পারব।”
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বর্তমানে সেখানে ৩০৬ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যারা সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে গত মে মাসে ফিরে এসেছিলেন।