ভাসানচরে পৌঁছাল রোহিঙ্গাদের প্রথম দল, দ্বীপের পরিবেশ দেখে ‘খুশি’
2020.12.04
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে স্থানান্তরের প্রথম ধাপে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে অবশেষে পা রেখেছে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গার প্রথম দলটি।
“শুক্রবার সকালে চট্রগ্রাম বোট ক্লাব এলাকা থেকে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে সাতটি জাহাজ ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুপুর সোয়া ২টার দিকে জাহাজগুলো ভাসানচরের ঘাটে পৌঁছায়,” বেনারকে বলেন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান।
ভাসানচর দ্বীপটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত।
রোহিঙ্গাদের ৩৯০টি পরিবার ভাসানচরে নামার পর তাঁদেরকে দুপুরের খাবার দেওয়া হয় বলে শুক্রবার বিকেলে ওই দ্বীপ থেকে টেলিফোনে বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু দ্দৌজা।
“এখন ৩৯০ পরিবারের সদস্যদের আবাসন সেন্টারে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা হচ্ছে,” জানান সামছু দ্দৌজা।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ছয়টি ও সেনাবাহিনীর একটি জাহাজে করে রোহিঙ্গারা ভাসানচরে পৌঁছান বলে সাংবাদিকদের জানান নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম কে জামান শামীম।
এদিকে জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর শুক্রবারের সংবাদ সংক্ষেপে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের খবরটি গুরুত্ব পেয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে ওই খবরে বলা হয়েছে, ভাসানচর এখনও বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বন্ধে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে। ভাসানচরের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা মূল্যায়নে জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি এখনো মেলেনি বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা স্থানান্তর বন্ধের আহবান জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফোর্টিফাই রাইটস।
এছাড়া বুধবার এক বিবৃতিতে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় জানায়, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
তবে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে ভাসানচর পরিদর্শনে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনা চলছে বলে গত ২৩ নভেম্বর বেনারকে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা বিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন।
রোহিঙ্গারা সন্তুষ্ট
ভাসানচরের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সেখানে যাওয়া রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবির থেকে যাওয়া মো. সালামত উল্লাহ ভাসানচর পৌঁছে মোবাইলে বেনারকে বলেন, “ভাসানচরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং এখানকার চাষবাদের পরিবেশ দেখে আমরা অনেক খুশি। এখানে আসার সিদ্ধান্ত সময়পযোগী হয়েছে বলে মনে করছি।”
তিনি বলেন, “এখানে আসার আগে ক্যাম্পে কিছু মানুষের কথা শুনে একটু ভয়ে ছিলাম। তারা বলেছিল, ভাসানচরের পরিবেশ ভালো না, সাগরের পানি ওঠে এবং মাটি নরম। তবে এখানে পৌঁছানোর পর বুঝেছি তাদের কথা সত্য নয়।”
“আসলে আমাদের এখানে খুবই ভালো লাগছে,” জানিয়ে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো সালামত উল্লাহ বলেন, “পরিবারের ৮ সদস্যকে নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে এসেছি।”
ভাসানচর যাত্রায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গী হয়েছেন বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীও। এদের মধ্যে একজন বেসরকারি বৈশাখি টেলিভিশনের সাংবাদিক কাজী বাপ্পা বেনারকে বলেন, “আমি যে জাহাজে ছিলাম, তাতে ২৫০ জনের মতো রোহিঙ্গা ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০ জনের সাথে কথা বলেছি। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছায় ভাসানচরে আসার কথা বলেছেন।”
“রোহিঙ্গারা মনে করছেন, এখানকার জীবন কক্সবাজারের চেয়ে নিরাপদ হবে। ভাসানচরে নামার পর পরিবেশ দেখে তাঁরা নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন,” বলেন বাপ্পা।
ভাসানচরে পৌঁছানো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩৬৮ জন পুরুষ, ৪৬৪ জন নারী এবং ৮১০ জন শিশু বলে বেনারকে জানান নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান হোসেন।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের বুধবার রাতে উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হয়। কড়া নিরাপত্তায় সেখান থেকে বৃহস্পতিবার বাসে করে তাঁদের চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁরা জাহাজে করে এসে পৌঁছান ভাসানচরে।
এছাড়া সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়া ৩০৬ জন রোহিঙ্গা গত মে মাস থেকেই ভাসানচরে রয়েছেন। তাঁরা সেখানে থাকতে না চাওয়ায় তাঁদেরকে কক্সবাজারে স্বজনদের কাছে ফেরানো হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তবে ঠিক কবে তাঁদের আনা হবে সে বিষয়টি এখনো ঠিক হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দ্দৌজা।
এদিকে চলতি সপ্তায় আরো সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচর পাঠানো হবে বলে নৌবাহিনী সূত্রের বরাতে শুক্রবার জানায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত হবার আহ্বান
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আগে আশ্রয় নেওয়াসহ বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছেন।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থীদের চাপ কমাতে দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
“কক্সবাজারের অতিরিক্ত জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু জন্ম নেয়ায় রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে,” শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
“কক্সবাজারের এই হতাশাগ্রস্ত” লোকদের কথা বিবেচনা করে সরকার জরুরিভাবে ভাসানচরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ খুব শিগগিরই এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত হবে।”
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
ভাসানচরে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে জানিয়ে শুক্রবার পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, সেখানে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য প্রায় ২২টি এনজিও কাজ করছে।
মিয়ানমারে ফিরতে হবে রোহিঙ্গাদের
বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং অবশ্যই তাঁদের সেদেশে ফেরাতে হবে। ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের এই নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানায় বাংলাদেশ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সাথে প্রত্যাবাসন শুরু করার কাজে জড়িত, যা এই সংকটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান।