গণহত্যার দায়ে দায়ী হতে পারেন মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা: জাতিসংঘ
2017.12.05
ওয়াশিংটন ডিসি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটির সেনাকর্মকর্তারা গণহত্যার অপরাধে দায়ী হতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংঠনের প্রধান।
মঙ্গলবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচআরসি) বিশেষ অধিবেশনে এই মন্তব্য করেন মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জাইদ আল-হুসেইন।
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মানবাধিকার কমিশনের এই বিশেষ অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়।
অধিবেশনে জাইদ রোহিঙ্গা এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি প্রতিবেদন পড়ে শোনান।
“এই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে। যার মধ্যে লোকজনকে ঘরে আটকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, নির্বিচার হত্যা, নারী ও কন্যা শিশুদের ধর্ষণ, বাজার এবং শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়ার বিবরণ রয়েছে,” বলেন জাইদ।
রাখাইন রাজ্যে ঘটা সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়ে জাইদ অধিবেশনে প্রশ্ন করেন, “গণহত্যা হিসেব চিহ্নিত হওয়ার জন্য এখানে যেসকল সম্ভাব্য উপাদান রয়েছে তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে?”
“আমরা অতি উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, ব্যাপকহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মিয়ানমার জাতীয়ভাবে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পরিচালনা করেনি। এখন পর্যন্ত, রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রবেশাধিকার হয় একেবারে নেই, অথবা খুবই সামান্য মাত্রায় আছে,” অধিবেশনে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম।
এদিকে রাখাইন রাজ্যের ঘটনার পেছনে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ের দায়ীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত পরিচালনার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুরোধ করার আহ্বানও জানান জাইদ।
এর আগে রাখাইনের চলমান ঘটনাকে ‘জাতি নির্মূলের আদর্শ উদাহরণ’ বলে মন্তব্য করছিলেন জাইদ।
প্রসঙ্গত, এর আগে জাতিসংঘ থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার পর মিয়ানমারের বিপক্ষে প্রস্তাবের জন্য ভোটাভুটিতে চীন মিয়ানমারকে সমর্থন করেছিল আর ভোটদানে বিরত থেকেছিল ভারত।
একইভাবে মঙ্গলবারের অধিবেশনেও চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রস্তাবে সমর্থন না থাকায় এতে কোনো বক্তব্য দেয়নি ভারত। এছাড়া মানবাধিকার কমিশনের মোট ৪৭ সদস্যের মধ্যে ৩৩ সদস্য এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে।
এ বছরের আগস্ট মাসের শেষ দিকে রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আক্রমণ চালায়। এর প্রেক্ষিতে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক দমন-পীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে ২৫ আগস্ট থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ৬ লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে মানবিক সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজি।
মিয়ানমারের সাথে চুক্তি: সমাধানের একটি মাত্র অংশ
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি সার্বিক সমস্যা সমাধানের একটি মাত্র অংশ বলে উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য অবহ্যাত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি অধিবেশনকে জানান, দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে সাম্প্রতিক চুক্তিটি দীর্ঘ মেয়াদি সমাধানের ‘একটি অংশ’ তবে “এটা এখন আর দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়।”
“বাংলাদেশ এই সমস্যার জন্য দায়ী নয়। বাংলাদেশ দশ লাখের মতো মানুষের ভার বহন করছে। যাঁদের মধ্যে ছয় লাখের বেশি মানুষ প্রবেশ করেছেন গত তিন মাসে,” বলেন শাহরিয়ার আলম।
তিনি বলেন, “আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সাথে যে চুক্তি করেছি, তার পাশাপাশি মিয়ানমার সরকার যাতে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে, সেজন্য এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।”
তবে, ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি হওয়ার পরও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে জাইদ বলেন, “রাখাইন রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করার আগে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত পাঠানো উচিত হবে না।”
এদিকে বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধি থিন লিন উত্থাপিত সব অভিযোগ অস্বীকার করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দেশটি জাতিসংঘের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথভাবে কাজ করছে জানিয়ে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আর কোনো রোহিঙ্গা শিবির থাকবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন তিনি।