রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে শীতবাহিত রোগের প্রকোপ
2017.12.06
ঢাকা ও কক্সবাজার

পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ঠান্ডাজনিত রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
ইতিমধ্যে শিশুদের মধ্যে ঠান্ডাজনিত ডায়ারিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। শীত ছাড়াও ক্যাম্পগুলোতে বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাবও নানা রোগের অন্যতম কারণ বলে সেখানকার স্থানীয় চিকিৎসকেরা মনে করেছেন।
রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা বিষয়ক মুখপাত্র কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাহীন মোহাম্মদ আব্দুর রহমান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “শীতকালীন রোগের প্রাদুর্ভাবে গত এক মাসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় শতাধিক রোহিঙ্গা শিশু সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।”
“এ ছাড়া ৭০-৮০ জন ডায়ারিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এই মুহূর্তেও ৮ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে,” জানান ডা. শাহীন।
সাধারণত ক্যাম্পের ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গাদের সেবা দেওয়া হয়। কেবলমাত্র রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলেই সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কুতুপালংয়ের আমতলীতে মাস তিনেক আগে এসে বসত গড়েছেন বিধবা রাহেলা ও তার সাত সন্তান। মাথা গোঁজার জন্য ৬ ফুট বাই আট ফুটের একটি ত্রিপলের ছাউনি এবং খাবারের জন্য চাল, ডাল পেলেও এখনো কোনো শীতবস্ত্র পাননি।
রাহেলা বলেন, “তীব্র শীতে ছোট ছোট বাচ্চারা ঘুমাতে পারছে না। পলিথিনের ঘরে রাতে মাটি থেকে ঠান্ডা উঠছে। আবার ওপর থেকে কুয়াশা পড়ে। যে কারণে এক বছরের শিশু জমিরের নিউমোনিয়া দেখা দিয়েছে। তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্য ডায়রিয়া ও কাশিতে ভুগছে।”
মধুরছড়া ক্যাম্পের ডি ব্লকের মাঝি (নেতা) রোকসানা বেগম বেনারকে বলেন, উখিয়াতে প্রচণ্ড শীত পড়ছে। এই মুহূর্তে যে পরিমাণ শীতবস্ত্রের দরকার তা নেই। যে কারণে তাদের ব্লকের প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ না কেউ নিউমোনিয়ায় কিংবা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।
শীত বাড়তে পারে
ডিসেম্বরের মধ্যভাগে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। কক্সবাজারের আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল পাল বলেন, “কক্সবাজারের চলতি সপ্তাহের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মধ্যরাতে ও খুব ভোরে তাপমাত্রা আরও কমে যায়। ডিসেম্বরের মধ্যভাগে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে।”
তবে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আব্দুস সালাম বেনারকে বলেন, ঠান্ডাজনিত ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে রোটা ভাইরাস ও টিকা দিতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মাঠে নামবে কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগ। ডায়রিয়া ও কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় গত দেড় মাসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে কলেরার ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) মুখপাত্র শিরিন আকতার জানান, ২৫ আগস্টের পর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৮৮ হাজার ১৩৭টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে জানান, “শীত পড়ার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে নিউমোনিয়া, ডায়ারিয়া, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এজমা, অ্যালার্জি ও সাইনোসাইটিসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।”
“এ জন্য জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় রোহিঙ্গাদের জন্য দ্রুত শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করা হয়েছে,” জানান মেজবাহ উদ্দিন।
রয়েছে পানি ও স্যানিটেশন সমস্যা
স্বেচ্ছাসেবক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে নিরাপদ পানি পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থার কারণে সেগুলোতে সার্বক্ষণিক ভিড় লেগেই থাকছে। যে কারণে এসব টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার রাখাও সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে টেকনাফের উনচি প্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত ডেনমার্কের ডাক্তার মার্ক জুয়ারা বেনারকে বলেন, “এই ক্যাম্পে গভীর নলকূপ নেই। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল। তাই এখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রায় ৪০ শতাংশ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত।”
“তিন মাস হলো এখানে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখানে পানির খুব অভাব। তিন মাসে মাত্র ১০-১৫ বার গোসল করতে পেরেছি। ফলে সারা শরীরে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে,” বেনারকে বলেন একই ক্যাম্পের ডি ব্লকে বসবাসরত আঞ্জুমান আরা।
ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোয় ন্যূনতম ১০০ ফুট গভীরতার নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও সেগুলো বসানো হয়েছে মাত্র ১৫-২০ ফুট গভীরে। ফলে অধিকাংশ নলকূপ বসানোর পরদিন থেকে অকেজো হয়ে গেছে।
টয়লেট ও নলকূপ ২০ মিটার দূরত্বে স্থাপনের কথা থাকলেও মাত্র দুই ফুট দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে টয়লেটের ময়লা অনায়াসে মিশে যাচ্ছে অগভীর নলকূপের পানিতে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় নলকূপ ও টয়লেট স্থাপনের কাজটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ক্যাম্পগুলোতে তিন হাজার নলকূপ ও পাঁচ হাজার স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান।
তিনি আরও জানান, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির উৎস স্থাপনে ২০০ কর্মী প্রতিদিন কাজ করছেন। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ২০০টি নলকূপ এবং ৫ হাজার টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৬০০ নলকূপ স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অকেজো হয়ে পড়া নলকূপ সম্পর্কে জানতে চাইলে কামরুল হাসান বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে পানীয়জলের জরুরি চাহিদা মেটাতে অগভীর নলকূপ করা হলেও বাকিগুলো গভীর নলকূপ করা হবে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছেন উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিছবাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, “সবকিছু এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা না গেলে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।”
“পানিবাহিত ও শীতজনিত রোগ যাতে মহামারি রূপ নিতে না পারে সে বিষয়ে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে সতর্ক করা হয়েছে,” বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।