রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের কার্যক্রম ও কার্যালয় বন্ধ
2019.12.06
ঢাকা ও কক্সবাজার

রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যক্রম ও কার্যালয় বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তবে ঠিক কী কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, সে বিষয়ে সংগঠনটি বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার দুই বছর পূর্তিতে কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে মহাসমাবেশ আয়োজনের পর থেকেই সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অবৈধ সংযোগ নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি এই সংগঠনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগও কেটে দিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ৩ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা মো. আয়াছ বেনারকে বলেন, “এ সংগঠনের কার্যক্রম এখন বন্ধ রয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে এর কার্যালয়টি বন্ধ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “বন্ধ করে দেওয়ার সঠিক কারণ জানি না। তবে ২৫ আগস্টের জনসভার পর থেকে এ সংগঠনটি চাপের মধ্যে ছিল।”
এই রোহিঙ্গা নেতার দাবি, “এ সংগঠনে সরকার বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড হয় না। মূলত রোহিঙ্গাদের দাবি দাওয়া এবং অধিকার আদায়ে কাজ করত এ সংগঠনটি।”
এদিকে শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের নির্দেশে সংগঠনটির অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে শুক্রবার বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানান সংগঠনের সেক্রেটারি মো. ছৈয়দ উল্লাহ।
তিনি জানান, পরবর্তীতে অনুমতি ছাড়া সেখানে কোনো ধরনের সমাবেশ না করার বিষয়েও ক্যাম্প ইনচার্জ নিদের্শ দিয়েছেন।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে সংগঠনটির অফিস বন্ধ করা হয়নি বলে শুক্রবার এএফপির কাছে দাবি করেন বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহবুব আলম তালুকদার।
তিনি বলেন, “আমরা কোনো অফিস বন্ধ করিনি। কিন্তু শরণার্থী শিবিরের সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবোধক করে তোলে এমন কিছু করার অনুমতি আমরা দেবো না।”
রোহিঙ্গা নেতাদের সরকারের তৈরি ‘মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সেন্টারে’ তাঁদের সভা করতে বলা হয়েছে বলেও জানান মাহবুব আলম তালুকদার।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিকারুজ্জামান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “গত ২৫ আগস্টের জনসভার পর থেকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড নেই।”
“সংগঠনটির অফিসের অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে সংগঠনের কার্যক্রম হয়তো বন্ধ রয়েছে,” বলেন তিনি।
এদিকে ২৫ আগস্টের পর থেকে সেই সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ পলাতক রয়েছেন বলে শুক্রবার বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল মনসুর।
‘কোনো চাপের মুখে বন্ধ রয়েছে’
গত দুই বছরে রোহিঙ্গাদের মূল কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা সংগঠনটির এই পরিণতির জন্য সরকারের চাপকেই দুষছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, মানুষকে সংগঠিত করার এমন সংগঠন বন্ধ করা অযৌক্তিক।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের ভালো মন্দ দেখভাল করার জন্য কোনো সংগঠন করার মধ্যে অন্যায় দেখি না। এটি স্পষ্ট যে, কোনো চাপের মুখে সেটা বন্ধ রয়েছে।
“এটি বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মত প্রকাশ করার চেষ্টা ব্যাহত হলো, নৈতিক ও মানবিকভাবে যা অযৌক্তিক,” বলেন তিনি।
নূর খান বলেন, “পলিথিনের ছোট ছোট খুপড়িতে রোহিঙ্গারা যেভাবে সময় পার করছে, তাদের সামাজিক যোগাযোগের জন্যও তো একটা জায়গা দরকার। সেটা বিবেচনা করলে সংগঠনিটর কার্যালয় বন্ধ করা হতো না। জানি না এর মধ্য দিয়ে কী অর্জন হলো।”
তিনি বলেন, “মানুষের সংগঠিত হওয়াকে আমি হুমকি মনে করি না। এর মাধ্যমে মানুষ উন্নয়নের দিকে প্রগতির দিকে সামাজিক উন্মেষ ঘটাতে পারে।”
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর অল্প সময়ের মধ্যে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে এ দেশে অবস্থান করছিলেন আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের প্রায় ৩৪টি শিবিরে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার প্রমাণ সংগ্রহের তাগিদ থেকেই ২০১৭ সালের শেষদিকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের জন্ম।
এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন মহিব উল্লাহ নামে একজন রোহিঙ্গা, যিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নেতা ও মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। এ বছরের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার দুই বছর পূর্তিতে কক্সবাজারের উখিয়ায় প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার বিরাট এক সমাবেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের ওই বিরাট সমাবেশ স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি করে। ওই সমাবেশের পর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উচ্চ গতির ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আশপাশে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশও দেওয়া হয়।