রোহিঙ্গা শিবিরে বিলুপ্ত ডিপথেরিয়ার হানা
2017.12.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া রোগ ডিপথেরিয়া শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা। ‘করনিব্যাক্টেরিয়াম ডিপথেরি’ নামক ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রামক এই রোগের প্রকোপ থেকে রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে শনিবার থেকে টিকা দেওয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সরকারের রোগ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইইডিসিআর ইতিমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এই সংক্রামক রোগের উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে ছয় লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা ত্রাণ সংস্থোগুলোর জোট আইএসসিজি।
রাখাইনে দমন নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা থেকেও বঞ্চিত।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১১০ জন ডিপথেরিয়া রোগি শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের ৬জন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন বলে বুধবার এক বিবৃতিতে জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
“তাদের এমএসএফ হাসপাতাল, মালেশিয়ান হাসপাতালসহ কয়েকটি স্থানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে,” ডিপথেরিয়া রোগীদের চিকিৎসা সম্পর্কে বেনারকে বলেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম।
“ডিপথেরিয়া অত্যন্ত সংক্রামক রোগ। শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। আক্রান্তের হাঁচি, কাশির মাধ্যমে এই রোগ খুব দ্রুত অন্যের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্তের গলার পেছন দিকে সরু পর্দা তৈরি হয়। এতে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা, পক্ষাঘাত, এমনকি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে,” বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসার ডা. মেজবাহ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “ডিপথেরিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া যে বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন করে তা শ্বসনতন্ত্রের বিশেষ করে নাক ও গলার টিস্যুকে নষ্ট করে দেয়। ডিপথেরিয়ার লক্ষণগুলো দেখা যায় ইনফেকশন হওয়ার দুই থেকে সাত দিন পরে।”
ডিপথেরিয়ার উপসর্গ সম্পর্কে ডা. মেজবাহ বলেন, “৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার জ্বর থাকে। ক্লান্তি ও শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। গলা ব্যথা হয়। গলার গ্রন্থি ফুলে যায়। ঢোক গিলতে সমস্যা ও ব্যথা হয়। অনেক বেশি কাশি হয়।”
তিনি আরও বলেন, “দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া যখন ভালো টিস্যুকে নষ্ট করে দেয় তখন মৃত টিস্যুগুলো পুরো ধূসর আবরণ তৈরি করে রোগীর গলা ও নাকে, একে সিউডোমেমব্রেন বলে। বিষাক্ত পদার্থ রক্তস্রোতে মিশে যেতে পারে, যার ফলে হার্ট, কিডনি ও নার্ভ ড্যামেজ হয়ে যায়।”
ডা. মেজবাহ জানান, গলার ভেতরে ধূসর আবরণ বা ফুলে যাওয়া টনসিল দেখে প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা হয়। এরপর আক্রান্ত স্থান থেকে টিস্যু নিয়ে কালচার করতে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে হয়।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীন মো. আব্দুর রহমান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথমে অ্যান্টিটক্সিন ইনজেকশন দিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে হয়। এ ছাড়া ইরাথ্রোমাইসিন ও পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় ইনফেকশন দূর করার জন্য।”
“যেহেতু এটি একটি সংক্রামক রোগ তাই ডিপথেরিয়ার রোগীদের অন্যদের থেকে আলাদা রাখতে হয়,” জানান তিনি।
আক্রান্তদের চিকিৎসা চলছে
৭০ বছরের বৃদ্ধ মো. আনাস রাখাইনের সহিসংতায় হারিয়েছেন দুই ছেলে ও এক নাতিকে। এরপর প্রাণ বাঁচাতে ১১ সদস্য নিয়ে পাড়ি জমান বাংলাদেশে। বর্তমান আশ্রয় কুতুপালং ক্যাম্পের মধুরছড়ার ই ব্লকে। এখানে আসার কয়েক দিন পর থেকে তার শরীরে জ্বর দেখা দেয়। হাত পাসহ গলা ব্যথা শুরু হয়। শ্বাসকষ্টও দেখে মিলে। এর জন্য গত এক মাস নিয়মিত জ্বর ও ব্যথার ওষুধ গ্রহণ করলেও তার রোগ ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি।
গত ৬ ডিসেম্বর তার গলাব্যথা বেড়ে গেলে তাকে এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তার শরীরে ডিপথেরিয়া রোগের জীবাণু খুঁজে পান।
এ বিষয়ে বৃদ্ধের মেয়ে হাসিনা আকতার বেনারকে বলেন, আমার বাবার শরীরে জ্বর দেখে ভেবেছিলাম বৃদ্ধ মানুষ আবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে বলে এমন হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার বলছে আমার বাবাকে ভয়ংকর জীবাণু আক্রমণ করেছে। যা তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
গুলশান পাহাড়ে বসবাসকারী তিন বছরের শিশু মরিয়ম গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে। মাঝে মধ্যে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। তার শরীরেও ডিপথেরিয়ার লক্ষণ রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে বৃহস্পতিবার তাকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
৫ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া হবে
কয়েক দশক আগে টিকাদানের মাধ্যমে ভয়ংকর এই রোগ নির্মূল করেছে বাংলাদেশ। এক বছরের মধ্যেই শিশুদের এই টিকা দেওয়া হয়। তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাবে নতুন করে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে রোগটি সংক্রমণের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই দ্রুত রোহিঙ্গাদের মধ্যেও এই টিকা দেওয়া হচ্ছে। শনিবার থেকে প্রথমে রোহিঙ্গা শিশুদের এই টিকা দেওয়া হবে জানিয়েছেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন।
সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ৯ ডিসেম্বর থেকে উখিয়ার ৪৮টি ও টেকনাফের ১২ টি ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের মাঝে এই টিকা প্রদান করবে। এতে ১২০ জন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করবেন।”
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় শিশুদের মাঝেও এই টিকা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
চ্যালেঞ্জ মনে করছেন চিকিৎসকেরা
এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে চিকিৎসা পেশায় আসা বাংলাদেশের চিকিৎসকরাও এখন ডিপথেরিয়া রোগের সঙ্গে অপরিচিত। এমন অবস্থায় এই রোগ মোকাবিলা একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেছেন তাঁরা।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. নোবেল বড়ুয়া বেনারকে জানান, এক যুগ আগে থেকে তিনি এই পেশায় আছেন। তার কয়েক বছরের সিনিয়র ও সমসাময়িক চিকিৎসকেরা এই রোগের সঙ্গে অপরিচিত।
“আমরা শুধু বইয়েই এই রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার পড়েছি। কিন্তু দেশে এই রোগে আক্রান্ত কাউকে খুঁজে পাইনি,” বলেন ডা. নোবেল।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বলছিলেন, “কয়েক দশক আগে শিশুদের মাঝে ভ্যাকসিন দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এই রোগ বিলুপ্ত করা হয়েছে। তাই এখানকার অনেক চিকিৎসকেরই এই রোগের ব্যাপারে ধারণা নেই। এখন এই রোগ মোকাবিলা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সিভিল সার্জন আরও বলেন, “রোহিঙ্গারা নানা ছোঁয়াচে রোগের জীবাণু বহন করে। আমরা এর আগে তাদের কলেরা, হাম ও পোলিও’র টিকা দিয়েছি।”
“ডিপথেরিয়া সমস্যা মোকাবিলায় সরকার তিন ধাপের পদক্ষেপ নিচ্ছে- আক্রান্তের সংখ্যা বের করা, আক্রান্তদের ব্যবস্থাপনা এবং টিকাদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ, যাতে নতুন কেউ আক্রান্ত না হয়,” বলেন ডা. সালাম।
ডিপথেরিয়া রোগীর জন্য উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একটি ওয়ার্ড খোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরে দ্রুত ডিপথেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানায় সংস্থাটি।
বাংলাদেশে ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি নবরত্নাস্বামী পারানিয়েথারান বলেন, “আশ্রয়শিবিরে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস করছে, যাদের অধিকাংশই এখনো টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আসেনি। তারা এমন একটা পরিবেশে বাস করছে, যেখান থেকে কলেরা, হাম, রুবেলা ও ডিপথেরিয়ার মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
নবরত্নাস্বামী পারানিয়েথারান বলেন, “সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকানোর একমাত্র উপায় শিবিরের মানুষগুলোকে, বিশেষ করে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা।”