যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে ঢাকা ছেড়েছেন ২৪ রোহিঙ্গা

আহম্মদ ফয়েজ ও আবদুর রহমান
2022.12.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রথম ধাপে ঢাকা ছেড়েছেন ২৪ রোহিঙ্গা নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের সুযোগ পাওয়া ছেলে সিরাজুল ইসলামের সাথে মোবাইলে কথা বলছেন কক্সবাজারের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের বসবাসকারী বাবা গুরা মিয়া। ৭ ডিসেম্বর ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শরণার্থীদের পুনর্বাসন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে থেকে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন ২৪ জন রোহিঙ্গা।

বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোরে তাঁরা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অফিস।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রথম ধাপে ৬২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।

আরআরআরসি মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “ভাসানচর ও কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত ৬২ জন রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে দেশটিতে যাবেন। তবে বিষয়টি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর তত্ত্বাবধান করছে।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ২৪ রোহিঙ্গার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

“এই ২৪ জন যাওয়ার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি শুরু হলো। ভবিষ্যতে আরও রোহিঙ্গা সেখানে যাবে,” বেনারকে বলেন এই কর্মকর্তা।

তবে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর অফিস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।

ইউএস ব্যুরো অব পপুলেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড মাইগ্রেশনের মার্কিন সহকারী সেক্রেটারি জুলিয়েটা ভালস নয়েস বাংলাদেশে তার পাঁচ দিনের সফর শেষ করার ঠিক একদিন পরই রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন শুরু হলো।

এর আগে গত বুধবার ঢাকায় নয়েসের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ৩০০ থেকে ৮০০ রোহিঙ্গা নেবে।

“এটা নিয়ে খুব উৎসাহী হওয়ার কিছু নেই। ১১ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৬২ থেকে ৩০০ জন নেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। বরং, এটি নতুন উদ্বেগ বাড়াবে। কারণ মিয়ানমারে বসবাস করা ছয় লাখ রোহিঙ্গাও এখন বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করতে পারে,” বলেন মোমেন।

এদিকে পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে নয়েস বলেছেন, “বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের অটল অংশীদারিত্ব এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে মার্কিন সরকার জাতিসংঘের শরণার্থী এবং অন্যান্য পুনর্বাসনকারী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত।”

গত ৩ থেকে ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবস্থানকালে কক্সবাজার এবং ভাসানচরের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন নয়েস।

তবে কতজন রোহিঙ্গাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত করা হবে তার পরিসংখ্যান এই বিবৃতিতে দেওয়া হয়নি।

এই পুনর্বাসন আসল সমাধান নয়

রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসন করার বিষয়টিকে আসল সমাধান মনে করছেন না প্রত্যাবাসন প্রত্যাশী রোহিঙ্গারা।

এ বিষয়ে আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বেনারকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করার বিষয়টি ভালো হলেও এটি মূল সমাধান নয়। এতে বরং সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনের যে ভাবনা, সেটি কমে যাবে।”

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। ভাসানচরে থাকা আমার ছেলে এ কথা জানিয়েছে, সেই তালিকায় তার নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।”

ইতোমধ্যে চার-পাঁচটি পরিবার সে দেশের উদ্দেশে ভাসানচর ত্যাগ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে প্রথম ধাপে তার ছেলে যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ধাপে হয়তো যেতে পারে। এর মাধ্যমে হয়তো আমরা সাময়িক স্বস্তি পাব। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো সব ভেঙেচুরে যাচ্ছে।”

প্রসঙ্গত, বর্তমানে নোয়াখালীর ভাসানচরে প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছেন।

“আমাদের শেষ চাওয়া হচ্ছে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া কিন্তু সেটি কখন সম্ভব তা বলা মুশকিল। এখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। অন্তত যাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল দেখছি,” বেনারকে বলেন লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।

মিয়ানমারে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে গত ৫ বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অস্বীকৃতিতে নিজ দেশে ফিরতে পারেননি একজনও। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন ১২ লাখ।

ফেরত নেবে মিয়ানমার, প্রত্যাশা বাংলাদেশের

যে কোনো মুহূর্তেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যেতে পারে দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ইতোমধ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কয়েকশ’ নাম যাচাই করেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ফ্লিট রিভিউ ২০২২ এর অনুষ্ঠান শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

যারা ২০১৬ সালের পরে বাংলাদেশে এসেছে তাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে রাজি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “কিন্তু যারা ২০১৬ সালের আগে এসেছে তাদের নিতে রাজি নয়। ইতোমধ্যে মিয়ানমার যেসব রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে, তাদের যেকোনো সময়ে সেদেশে নিয়ে যেতে পারে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা ২০১৬ সালের আগে এসেছিল তাদের সংখ্যা ৩৩ হাজার। তাদের মিয়ানমার না নিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রসহ যে দেশগুলো রোহিঙ্গা নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে অনুরোধ করা হবে নিয়ে যেতে।

গত ৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর পরিবারের ১০ সদস্য কানাডার উদ্দেশে ক্যাম্প ছেড়েছিলেন। এর আগে দুই দফায় মুহিব উল্লাহর পরিবারসহ ২৫ জন আত্মীয় স্বজন কানাডায় গেছেন।

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিব উল্লাহ নিহত হওয়ার পর তার পরিবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশে (থার্ড কান্ট্রি) আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাম উল্লেখ করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।