রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা: গাম্বিয়াকে কারিগরি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2019.12.09
ঢাকা ও কক্সবাজার
191209_ICJ_rohingya_1000.JPG নেদারল্যান্ডের হেগ-এ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন রোহিঙ্গা নারী হাসিনা বেগম। ৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
[রয়টার্স]

রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলার শুনানি মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডের হেগ-এ শুরু হচ্ছে। শুনানিতে মামলাকারী দেশ গাম্বিয়াকে ‘কারিগরি সহায়তা’ দিতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ২০ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে সোমবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।

আইসিজেতে গণহত্যার মামলার শুনানি শুরু হওয়ার দুদিন আগে চার দিনের এক সরকারি সফরে মিয়ানমার গেছেন বাংলাদেশ সেনাপ্রধান আব্দুল আজিজ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে রোহিঙ্গা সংকটসহ দুদেশের সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বসানো স্থলমাইন ও ইম্প্রুভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি।

বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগের পরিচালক লেঃ কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ।

উল্লেখ্য, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি’র পক্ষে গত ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।

কারিগরি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে ওআইসির পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া। বাংলাদেশের এখানে সরাসরি কিছু করার নেই। তবে এক্ষেত্রে গাম্বিয়া কোনো কারিগরি সহায়তা চাইলে আমরা সেটি করব।”

তিনি বলেন, “এই সহায়তা দিতে আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল হেগ-এ রওনা হয়েছেন। গাম্বিয়া চায়, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করুক এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যদি আন্তর্জাতিক আদালত থেকে এই ঘোষণা আসে তাহলে আমাদের দেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের বলতে পারব, ‘মিয়ানমার রাখাইনে তোমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এখন তোমরা সেখানে ফিরে যাও’। তারা সবাই ফিরে যেতে চায়। নিরাপত্তার অভাবে তারা যেতে পারে না।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমার আমাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেখানে তারা বলেছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সমাজের অংশ। কিন্তু এখন তারা বলে বেড়াচ্ছে যে রোহিঙ্গারা অবৈধ বাংলাদেশি।”

আবদুল মোমেন বলেন, “মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, প্রতিবেশি। আমরা তাদের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা রাখি, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে হবে।”

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিষয়ে শুনানি শুরুতে কিছুটা আশার আলো দেখছেন রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “আমরা আমাদের দেশ আরাকানে (রাখাইনে) ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরিবেশ নেই। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ সকল অপরাধের বিচার চাই।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক আদালতে যে শুনানি হতে যাচ্ছে তাতে আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা বিচার পাব। এতবড় অপরাধ করে মিয়ানমার মিলিটারি পার পেয়ে যেতে পারে না।”

সেলিম বলেন, “মিয়ানমার মিলিটারির বিচার করা গেলে আমাদের নিরাপত্তা আসতে পারে। অন্যথায় ওরা আমাদের সবাইকে শেষ করে দেবে।”

সেনাপ্রধানের মিয়ানমার সফর

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ রোববার চার দিনের সরকারি সফরে মিয়ানমার গেছেন বলে বেনারকে জানান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগের পরিচালক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ।

সফরকালে তিনি মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর উপ প্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধান ভাইস সিনিয়র জেনারেল সো উইনের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।

লেঃ কর্নেল আবদুল্লাহ বলেন, “সাক্ষাৎকালে তাঁরা দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ বিনিময়, শুভেচ্ছা সফর ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমার নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ হতে প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করবেন।”

তিনি বলেন, “পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় সড়ক নির্মাণ এবং মিয়ানমার কর্তৃক সীমান্ত এলাকায় স্থল মাইন ও আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) স্থাপন সম্পর্কেও আলোচনা হতে পারে।” আগামী ১১ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন সেনাপ্রধান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বেনারকে বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। এই অবস্থায়ও আমরা মিয়ানমারের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সেনাপ্রধান বর্তমানে মিয়ানমার সফরে রয়েছেন। সেখানে হয়তো বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আলোচনা হবে।”

তিনি বলেন, “অর্থাৎ মিয়ানমারের সাথে আলোচনা চলবে। আবার আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও চলবে। আমরা চাই, যেভাবেই হোক না কেন রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে হবে।”

ফারুক খান বলেন, “এ ধরনের বিচার সাধারণত প্রায় দুবছর ধরে চলে। যদি আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়, ভালো। আর যদি আদালতের রায়ের মাধ্যমে হয় সেটিও ভালো। আমরা দুভাবেই কাজ করব।”

কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ শুরু

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কক্সবাজারে শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। যার মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও জঙ্গিবাদের ঝুঁকিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

তিনি বলেন, “সব মিলিয়ে এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠী যাতে দেশের ভেতর ঢুকে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য কাঁটাতারের বেড়া বড় ভূমিকা রাখবে।”

কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের দাবি জানায় পুলিশ।”

তিনি বলেন, “বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শিবির পাহাড়ী এলাকায় এবং এসব ক্যাম্পে কাঁটাতারের ঘেরা না থাকায় অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ শেষ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়ক হবে।”

শরণার্থী শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিরোধিতা না করলেও রোহিঙ্গারা বলছেন, এই বেড়া তাদেরকে বন্দি করে রাখার মতো।

লাম্বারশিয়া এলাকার রোহিঙ্গা শরণার্থী মো. ইলিয়াস বেনারকে বলেন, “নিজ দেশেই আমরা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে ছিলাম। এখানে কিছুদিন কিছুটা স্বাধীনতা পেলেও আবার কাঁটাতারে বন্দি হতে যাচ্ছি। আমরা হয়তো বন্দিই থাকব সারাজীবন।”

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারী মো. ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। আমরা সরকারের সিদ্বান্তের বিরোধিতা করব না। এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।