মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার শুনানি শুরু
2019.12.10
ঢাকা ও কক্সবাজার

আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯। ইস্টার্ন সময় বিকাল ০৪.৩০
নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গাদের গণহত্যা মামলার শুনানি শুরু হয়েছে মঙ্গলবার।
প্রথম দিনে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির পক্ষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলাকারী দেশ গাম্বিয়ার যুক্তি উপস্থাপন করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।
তবে এই শুনানির আগেই মঙ্গলবার সকালে সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উখিয়ায় সমাবেশ করে গাম্বিয়ার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী।
বিচার শুরুর দিনকে স্মরণীয় দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
সমাবেশ শেষে রোহিঙ্গা শিবিরের মসজিদ ও মাদ্রাসায় বিশেষ দোয়া করেছেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচার হবে বলে আশা করে অনেকে রোজা রেখেছেন।
রোহিঙ্গা নিপীড়নের দুবছর পূর্তিতে এবছর ২৫ আগস্ট উখিয়া শরণার্থীশিবিরে লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো সমাবেশ করল রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানো হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেছেন, গাম্বিয়ার যুক্তি উপস্থাপন ভালো হয়েছে। তিনি আশা করেন আদালত থেকে ‘ভালো কিছু’ আসবে।
মঙ্গলবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত মানবাধিকার দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ামারের সাথে দ্বিপাক্ষিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো সংঘাতে জড়াচ্ছি না, বরং আলোচনা হচ্ছে। কারণ তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।”
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান বিচারের কারণে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়বে। আর সেই চাপ কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে রাজি করতে চেষ্টা চালাবে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গাদের মোনাজাত, রোজা
হেগ শহরে শুনানি শুরু আগের দিন সোমবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিছিল-সমাবেশের অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবদেন করেছিল আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠন।
ওই সংগঠনটি এবছর ২৫ আগস্ট লাখো রোহিঙ্গা জড়ো করে মহাসমাবেশ করেছিল।
তবে সমাবেশের অনুমতি না পেলেও মঙ্গলবার সকালে উখিয়া শরণার্থী শিবিরে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার শরণার্থী সমাবেশে অংশ নেন।
তারা ইংরেজিতে লেখা বিভিন্ন স্লোগান সমৃদ্ধ ব্যানার নিয়ে সমাবেশ করেন। সমাবেশে ‘গাম্বিয়া, গাম্বিয়া’ চিৎকার করে হাত উঁচিয়ে আফ্রিকার দেশটির প্রতি সমর্থন জানান তাঁরা।
মঙ্গলবার সকালে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে এ মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে মোনাজাত করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান সংগঠনটির সেক্রেটারি মো. ছৈয়দ উল্লাহ।
তিনি বলেন, “সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় মোনাজাত করা হয়। কেউ কেউ বিচার চেয়ে রোজা রেখেছেন।”
ছৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “১৯৬২ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগেরা। সেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আজ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু হয়েছে। এদিনটি রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই স্মরণীয় দিন।”
তিনি বলেন, “তাই নানা কর্মসূচি পালনের জন্য অনুমতি চেয়েছিলাম। সরকারের কাছ থেকে অনুমতি না পেয়ে এ মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে মোনাজাত করা হয়েছে। মোনাজাতে গাম্বিয়া এবং বাংলাদেশের সমৃদ্ধিও কামনা করা হয়।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের শুনানির সংবাদ ও কার্যক্রম দেখার জন্য শরণার্থী শিবিরে টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন অনেক রোহিঙ্গা।
উখিয়ার কুতুপালং সাত নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. ইউনুচ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচার শুরু হওয়ায় আমরা খুবই খুশি। আশা করছি আমরা ন্যায় বিচার পাব। তাই বিচার কার্যক্রম দেখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসে আছি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় আমরা এখানে আশ্রয় পেয়েছি, সেজন্য সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞ।”
বালুখালী ১২ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, “১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমার আমাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, মা-বোনকে হত্যা করেছে, জায়গা জমি কেড়ে নিয়েছে, আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আজ সেই বিচার শুরু হয়েছে, আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন ন্যায় বিচার পাই।”
রোহিঙ্গা নেতা এহেসানুল হক বলেন, “বিচারের জন্য আমরা খুশি। ২০১২ সাল থেকে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বিচার যাতে সুন্দরভাবে হয় তার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।”
তিনি বলেন, “আর এ মামলার জন্য আমাদের কাছে যদি ডকুমেন্ট চায় তা দেওয়ার জন্যও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। যোগ করেন তিনি।”
এদিকে শুনানি শুরু হওয়ার আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মামলা করায় গাম্বিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।
রোববার এক টুইট বার্তায় সংগঠনটির কমান্ডার ইন চিফ আতাউল্লা বলেন, “এর জন্য সারা বিশ্বের যে সকল রাজনীতিবিদ ও রোহিঙ্গা অধিকার কর্মীরা দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাঁদেরেকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।”
“আমি আশা করি আপনারা সকলে নির্যাতনকারী বার্মিজ সেনাবাহিনীর আসল চেহারা উন্মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন,” বলেন আতাউল্লা।
‘ভালো কিছু হবে’
আইসিজে আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচারের শুনানি সম্পর্কে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “হ্যাঁ গাম্বিয়ার বক্তব্য শুনেছি। খুব ভালো হয়েছে প্রেজেন্টেশন। আশা করি ভালো কিছু হবে।”
তিনি বলেন, “রাখাইনে এখনো যেসকল রোহিঙ্গা বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের অ্যাট্রসিটিজ, অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছ থেকে একটি অন্তর্বর্তী আদেশ চেয়েছে গাম্বিয়া। আদালতে যদি এমন কোনো রায় দেয় তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।”
মন্ত্রী বলেন, “আর রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যাবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের সেনাপ্রধান মিয়ানমার সফরে রয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাত করেছেন।”
ড. মোমেন বলেন, “মিয়ানমারের অনেক সিদ্ধান্ত এখনও সেদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে থাকে। সুতরাং, দুদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সেনাপ্রধানের মধ্যে আলোচনা আরেকটি যোগাযোগের মাধ্যম। তাঁদের মধ্যে আলোচনা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আজ আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানি শুরু হয়েছে। আগামীকাল মিয়ানমার তার যুক্তি তুলে ধরবে। আদালত সাক্ষীদের শুনবে। এরপর রায় দেবে। প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ।”
তিনি বলেন, “তবে রাখাইনে যেসকল রোহিঙ্গা অবস্থান করছে মিয়ানমারের নির্যাতনের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্য একটি জরুরি অন্তর্বর্তী আদেশ চেয়েছে গাম্বিয়া।”
রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, “তবে আমার মনে হয়, এই মামলায় খুব বেশি সময় লাগবে না।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ হয়তো চাইবে আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান মামলার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে। আবার মিয়ানমারও হয়তো তাদের আন্তর্জাতিক ইমেজের কারণে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে।”
হুমায়ূন কবির বলেন, “তবে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিলেই আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একটি দিক। আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধের বিচার বিষয়টি আরেক বিষয়। আদালত দেখবে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ওই গণহত্যাসহ ওই সকল অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কি না। আর হয়ে থাকলে এর দায়দায়িত্ব কার। আর যারা অপরাধী তাদের ব্যাপারে রায় দেবে আদালত।”