ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর, স্বেচ্ছায় কিনা যাচাই করতে চায় জাতিসংঘ, সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের
2020.12.10
ঢাকা

বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচর শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগী কিনা তা যাচাইয়ে জাতিসংঘকে স্বাধীনভাবে সুযোগ না দিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে এ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়। মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যান্ড্রুস ওই উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেন।
ভাসানচরে স্থানান্তরিত ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ ও সঠিক তথ্য পেয়ে স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা তা যাচাইয়ে একটি স্বতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরুরও দাবি জানিয়েছেন তিনি।
“এই যাচাইকরণ ও মূল্যায়ন সবার স্বার্থেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ,” উল্লেখ করেন অ্যান্ড্রুস।
কিছু রোহিঙ্গাকে জোর করে বা ভুল তথ্য দিয়ে স্থানান্তর করার খবরে উদ্বিগ্ন ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরির ব্যর্থতার কারণে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ সরকার, উভয় পক্ষের মধ্যে একটি অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে।”
এই অবস্থায় জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মূল্যায়নের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে স্থানান্তরে শরণার্থীদের প্রস্তুত করার আহবান জানান এই কর্মকর্তা।
একইদিন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও এক বিবৃতিতে ভাসানচরে শরণার্থী স্থানান্তর করার নিরাপত্তা, সম্ভাব্যতা এবং প্রত্যাশা নির্ধারণের জন্য জাতিসংঘের কারিগরি ও সুরক্ষা মূল্যায়নের প্রস্তাব গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে।
“ভাসানচরে স্বাধীনভাবে আসা-যাওয়ার সুযোগ এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে যে, শরণার্থীরা সেখানে নিজেদের ইচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়েছিলেন এবং তাঁরা স্বেচ্ছায়ই সেখানে রয়েছেন। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমী বন্যা প্রতিরোধের জন্য এলাকাটির উপযুক্ততাও প্রমাণিত হবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
“বাংলাদেশ জানিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা চাইলে মূল ভূখণ্ডের শিবিরে ফিরে যেতে পারেন,” উল্লেখ করে স্থানান্তরিত শরণার্থীদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সরকারকে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহবান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
এদিকে আজকের এসব বিবৃতি সম্পর্কে অবহিত নন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
তবে তিনি বলেন, “জাতিসংঘের উচিত মিয়ারমারে রাখাইনের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে যাওয়া। এই শরণার্থীদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, সে বিষয়টিই তাদের সবার আগে যাচাই করা উচিত।”
“একজন রোহিঙ্গাকেও জোর করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়নি,” দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “স্বেচ্ছায় যারা গেছে, কেবল তাদেরই নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গা যাওয়ার কথা ছিল। অনেকেই যাননি। আমরা তাদের জোর করিনি।”
এর আগে রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে জানান, ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ কখনো সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেয়নি।
“তারা (জাতিসংঘ) এ ব্যাপারে মুখে মুখে বলছে, কোনো চিঠি দিয়েছে বলে আমার জানা নেই,” জানিয়ে জাতিসংঘ ভাসানচরে যেতে চাইলে সরকারের কোনো আপত্তি নেই বলেও উল্লেখ করেন ড. মোমেন।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র লুইস ডোনোভান জানান, তাঁরা ধারাবাহিকভাবে ভাসানচরে প্রবেশাধিকার চেয়ে আসছেন।
“জাতিসংঘের প্রস্তাবিত প্রযুক্তিগত ও সুরক্ষা মূল্যায়নসহ ভাসানচর প্রকল্প সম্পর্কিত বিষয়ে সরকারের সাথে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা আশাবাদী,” বেনারকে বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে এক লাখ নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
তবে শুরু থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতার মুখেই গত ৪ ডিসেম্বর নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সাতটি জাহাজে করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে ৩ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা স্থানান্তর বন্ধের আহবান জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফোর্টিফাই রাইটস।
এছাড়া ২ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের কার্যালয় জানায়, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
‘ভাসানচর অনেক গোছালো ও সুন্দর’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় “যেসব কারণ দেখিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের যেতে দিতে চাচ্ছে না সেগুলো খুবই ঠুনকো অজুহাত,” বলে মন্তব্য করেন পৃথিবীর বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের সাথে ভাসানচর প্রকল্পের তুলনামূলক পর্যালোচনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলের প্রধান এবং শান্তি ও সংঘাত অধ্যায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম।
গত মাসে ভাসানচর সফর করে আসা এই গবেষক বলেন, “আমিও রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে রেখে আসার সমর্থক ছিলাম না। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে, বিপদজনক তো নয়ই, বরং এলাকাটি অনেক গোছালো ও সুন্দর।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, “আমাদের একটাই চিন্তা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। তার আগে এমন একটি অবস্থায় রাখতে হবে যাতে তারা স্থানীয়দের জন্য বড় ধরনের হুমকি না হয়ে দাঁড়ায়।”
ভাসানচরে খুশি নারী ও শিশুরা
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি দাবি করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে খুশি। তাঁদের প্রতিক্রিয়াটা খুবই আশাব্যঞ্জক।”
স্থানান্তরের কাজে সরকারের পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় ২২টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা আমাদের আকাঙ্খা অনুযায়ীই সেবা দিতে পেরেছে।”
এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. রাশেদুল ইসলাম বেনারকে জানান, “এনজিওগুলো আমাদের বলেছে, তারা সেখানে সাফল্যের সাথে কাজ করতে পারলে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ভয়টাও কেটে যাবে।”
ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলোর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের আলহাজ্ব শামসুল হক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ নাছির উদ্দীন বেনারকে বলেন, “যারা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার বিরোধিতা করছে, তারা সেখানে যায়নি বলেই অমনটা করছে।”