রোহিঙ্গা সংকট: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে কাছে পায়নি বাংলাদেশ
2017.12.11
ঢাকা

২৫ আগস্টের পর স্রোতের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে প্রশংসাসূচক কাজ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিরাট এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর যে ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল, সে ভূমিকা তারা পালন করেনি।
এমনই পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর) নামে দক্ষিণ এশিয়া ভিত্তিক মানবাধিকার কর্মীদের একটি মোর্চা। গত ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর কক্সবাজারের তিনটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে তারা।
সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এসএআরএইচ তাদের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট উপস্থাপন করে।
এসএআরএইচ এর চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধানের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সহায়তা প্রয়োজন ছিল। যেটা হয়নি।”
“বাংলাদেশ এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবু বাংলাদেশ লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা ত্রাণ কার্যক্রম থেকে শুরু করে মাঠের কোথাও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর তেমন উপস্থিতি দেখিনি,” সুলতানা কামাল বলেন।
হিন্দুস্তান টাইমসের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক ভারত ভূষণ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “ভারতের পত্রপত্রিকায় রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সেভাবে লেখালেখি হয়নি। ফলে সেখানকার পাঠক সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে সেভাবে জানার সুযোগ পায়নি।”
“প্রধানত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যা ছাপা হয়েছে ভারতের মানুষ তার ওপরই নির্ভর করছে। দু-একটি পত্রপত্রিকা ছাড়া কেউ তাদের প্রতিনিধি পাঠায়নি। ফলে অনেক মানুষ রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়নি,” ভারত ভূষণ বলেন।
তিনি বলেন, “ভারত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। সে দেশের মানুষ আর যাই হোক এথনিক ক্লিনজিং এর পক্ষে দাঁড়াতে পারে না।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে হিন্দুস্তান টাইমসের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক বলেন, “ভারত যে কালাদান প্রকল্পের জন্য মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তার সফলতা রাখাইনের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করছে।”
তবে মালদ্বীপ শুরুতেই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় বলে বেনারনিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন সে দেশ থেকে আসা মানবাধিকার কর্মী জিহান মাহমুদ।
“আমাদের মিডিয়া এই ইস্যুতে খুবই সোচ্চার ছিল। আমাদের সরকার দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে প্রথম, যে দেশটি মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছেদ করেছে,” জিহান মাহমুদ বলেন।
যা দেখেছে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি
শরণার্থীরা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে রাখাইনে তাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছে। তারা বলেছে, এক গ্রামে আগুন দিয়ে তারা অন্য গ্রামের লোকদের বলেছে দ্রুত পালিয়ে যেতে। তারা শুধু প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে।
তবে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলেও নারীরা এ ব্যাপারে ছিলেন মারাত্মক রকমের নীরব।
মানবাধিকার কর্মী সারা হোসেন মনে করেন, এ বিষয়গুলোর তদন্ত হওয়া জরুরি।
“বহু নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকে গর্ভবতী। তাঁরা নির্যাতনের কারণেও গর্ভবতী হয়ে থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে,” এক প্রশ্নের জবাবে বলেন সারা হোসেন।
সুলতানা কামাল বলছিলেন, শরণার্থী শিবিরের লোকজনের করার মতো কোনো কাজ নেই। তারা শুধুমাত্র ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল। তাদের প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে, শিশুদের লেখাপড়া করানোর কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ শিশুদের লেখাপড়া শেখার কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শাকিল ফয়জুল্লাহ বেনারকে জানান, শিশুদের জন্য তাঁরা দেড় হাজার লার্নিং সেন্টার চালু করেছেন। সেখানে ৫০ হাজার শিশু খেলাধুলা ও প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। তবে সব শিশুকে এর আওতায় আনা যায়নি।
“আপাতত ৫০ হাজার শিশুকে আমরা সেবা দিতে পারছি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ এক হাজার। তবে মোট শিশুর সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার। বর্মি ভাষা যারা জানেন তাদের আমরা লার্নিং সেন্টারে যুক্ত করছি,” বলেন শাকিল ফয়জুল্লাহ।
কাজ চলছে, প্রয়োজন আরও
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসেবে ২৫ আগস্ট থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
জেনোসাইড, নির্বিচারে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে এসএআরএইচ মনে করে। জানা গেছে, এ নিয়ে মাঠে কাজ চলছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “যথাযথ তথ্যপ্রমাণ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।”
“জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা মাঠে কাজ করছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে রীতিপদ্ধতি অনুসরণ করে। এগুলো পরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ব্যাপারে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে,” বলেন নূর খান।
তবে শিবিরগুলোর নিরাপত্তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার কমিউনিকেশন ম্যানেজার আয়েশা আখতার জানান, রোহিঙ্গা রিফিউজি রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশন (ট্রিপল আর সি) এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অবস্থানরত এক লাখ ১৩ হাজার ২৪৬ পরিবারকে চিহ্নিত করেছে।
“এই পরিবারগুলোর জনসংখ্যা ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৭২৫ জন। কমপক্ষে ৩০ শতাংশ পরিবারে অন্তত একজন সদস্য ঝুঁকির মধ্যে আছে,” তাঁদের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেন আয়েশা আখতার।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শরণার্থী শিবিরগুলোকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের পরিচয় গোপন রেখে কাজে নিয়োগ দেওয়া, পাচার করা, ঠকানো, অন্যায়ভাবে ব্যবহার করার মতো ঘটনা ঘটেছে।
তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন বলেছেন, শরণার্থী শিবির এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
খুব শিগগির সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন নিরাপত্তার কাজে যুক্ত হবে বলেও জানান তিনি।