রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা: সু চির বক্তব্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান
2019.12.11
ঢাকা ও কক্সবাজার

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) বুধবার মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। তাঁরা বলছেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনী এবং তাদের বৌদ্ধ দোসররা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ নিয়েই নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে।
বুধবার ছিল নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানির দ্বিতীয় দিন। সেখানে নিজের দেশের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপনকালে সুচি নিজ দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।
আদালতকে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে অভিযানে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে তার পেছনে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল বলে আদালতকে জানান সু চি।
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করে তিনি আরও বলেন, সেসময় কিছু লোক ভয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে প্রবেশ করেছিল। কক্সবাজারের শিবিরে শরণার্থীরা টিভিতে এই বিচার কার্যক্রম দেখে সুচিকে নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
“আমরা ভয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি তাঁর এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি। তিনি সেনাবাহিনী এবং মগদের সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা কথা বলছেন,” বেনারকে বলেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল করিম। এ সময় উখিয়ার কুতুপালং টিভি রীলে সেন্টার সংলগ্ন রোহিঙ্গা শিবিরের একটি চায়ের দোকানে বসে টেলিভিশনে বিচার কার্যক্রম দেখছিলেন তিনি।
সুচি সামারিক বাহিনী ও মগদের পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন রাখাইন রাজ্যের মংডুর ঢেকিবুনিয়ার বাসিন্দা আব্দুল করিম।
তিনি বেনারকে বলেন, “২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে বর্মিজ মিলিটারির গুলিতে আমার ভাই ও স্ত্রী মারা যায়। আমরা যখন বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলাম তখন তারা পেছন থেকে গুলি করছিল আর ‘চলে যা, চলে যা’ বলে চিৎকার করছিল।”
“সে বছর আগস্টের শেষের দিকে, মিয়ানমারের আর্মিরা আমার মেয়েকে নিকটবর্তী জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায় এবং গণধর্ষণ করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। তাকে খুঁজে পেয়ে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে নিয়ে আসি আমরা,” বেনারকে বলেন মংডুর জেলাতলির বাসিন্দা আয়েশা।
প্রসঙ্গত, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোর পক্ষে নভেম্বরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ামনারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। শুনানির প্রথম দিন মঙ্গলবার গাম্বিয়া ও বুধবার মিয়ানমার নিজ নিজ দেশের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। শুনানির তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার আবারো গাম্বিয়া ও মিয়ানমার সংক্ষিপ্তভাবে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করবে।
সেনাবাহিনীকে বাঁচানোর চেষ্টা সুচির
এদিকে সেনাবাহিনীকে বাঁচাতেই তাদের পক্ষ নিয়ে আইসিজেতে সুচি সম্পূর্ণ মিথ্যা যুক্তি উপস্থাপন করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বেনারকে বলেন, আমি আইসিজেতে সুচির উপস্থাপনা দেখেছি। তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন এবং সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন।
“সুচি মূলত সামরিক বাহিনী এবং তাদের বৌদ্ধ দোসরদের রক্ষা করেছেন, যারা প্রতিটি রোহিঙ্গা গ্রামে গিয়ে গণহত্যার অভিপ্রায়ে সমস্ত বয়সের নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল,” বলেন তিনি।
“যারা পালাতে পেরেছে তারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সুতরাং রোহিঙ্গারা ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছে বলে সু চির দাবি সম্পূর্ণ অসত্য,” বলেন অধ্যাপক রেহমান।
“সুচি আরসার ওপর দোষ চাপিয়ে সামরিক অভিযানকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পুরো বিষয়টি বিচারপতিদের ও আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে আরসা সদস্যরা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
“জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, রাখাইনে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। তা ছাড়া স্যাটেলাইটের ছবিও প্রমাণ করে যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সমস্ত রোহিঙ্গা গ্রাম সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে,” বলেন তারেক শামসুর রেহমান।
“মিয়ানমার কয়েক দশক ধরে নিয়মিত পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের নীতি অনুসরণ করে আসছে। ১৯৮২ সালে তারা রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করতে নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়,” বলেন তিনি।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লড়ছেন সুচি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ফারুক খান বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পক্ষ সু চির অবস্থান দেখে দুঃখ হয়। তবে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হেগ-এ গিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “২০২০ সালে মিয়ানমারে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশটির সামরিক বাহিনী ও কট্টরপন্থী বৌদ্ধরা বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সুতরাং নিজের দলের প্রতি এই দুটি পক্ষের সমর্থনের জন্য তিনি হেগ-এ তাদের হয়ে লড়ছেন।”
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, “সু চি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক ছিলেন। একসময় আমি কারাগার থেকে তাঁর মুক্তি দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলাম। তবে তাঁর সেই অবস্থানের অধঃপতন হয়েছে।”
বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারের সাথে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
“তিনি সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন দেখে আমি দুঃখ পেয়েছি,” বলেন ড. মোমেন।
তিনি বলেন, “মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য দেশজুড়ে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।”
“মিয়ানমারকে আরও সুরক্ষিত, স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী একটি দেশে পরিণত হতে হলে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অব্যাহত দায়মুক্তি অবশ্যই বন্ধ হতে হবে,” বলেন তিনি।