নির্বাচনে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী তাই ভাসানচরে যাওয়া হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের
2018.12.12
কক্সবাজার

মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপ প্রস্তুত হলেও নির্বাচনের আগে সেখানে তাঁদের স্থানান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তাঁরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্রয় শিবির উদ্বোধন করার আগে কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হবে না।
৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাসানচর সফরের মাধ্যমে সেখানে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল বলে বুধবার বেনারকে জানান নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস। তবে তিনি বলেন, সেই সফর বাতিল হয়ে যায়।
তন্ময় দাস বুধবার বেনারকে বলেন, “এখন আমরা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। নির্বাচনের আগে ভাসানচরে রোহিঙ্গা সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য আসেনি। বলা যাচ্ছে না নির্বাচনের আগে সম্ভব হবে কি না।”
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বেনারকে জানান, “এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ভাসানচর সফর করার কোনো তারিখ নির্ধারণ করেননি।”
এদিকে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর ভাসানচর যাবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলে বুধবার বেনারকে জানান প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
তিনি বলেন, “আজ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। উনি এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। নির্বাচনের আগে সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”
গত বছর ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরু হলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে।
সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা আরও প্রায় তিন লাখসহ কমপক্ষে এগারো লাখ বাড়তি মানুষ এখন উপজেলা দুটির শরণার্থীশিবিরে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে।
কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর আশ্রয় শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীকে।
সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২,৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সরকারের রোহিঙ্গা সেলের প্রধান শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, নৌ-বাহিনীর কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ভাসানচরের শতকরা ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন রোহিঙ্গারা সেখানে থাকতে পারবে। তবে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের আগে সেখানে হস্তান্তর হবে না।
কী আছে ভাসানচরে?
ভাসানচর প্রকল্পের দলিল অনুযায়ী, সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষা করতে পুরো চরের প্রান্ত ঘেঁষে নয় ফুট উঁচু ১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা শেষ হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে ২১১ কোটি টাকা।
ভাসানচরকে সাগরের পানি থেকে রক্ষা করতে চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রো এই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে।
প্রকল্পের সাথে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, পর্যায়ক্রমে এই বাঁধ ২১ ফুট উঁচু করা হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো বাঁধে ভাঙন ঠেকাতে বেলাভূমিতে পাথরের নুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি জানান, এ ছাড়া সাগরের ঢেউ যাতে সরাসরি আঘাত না করে সে জন্য বাঁধের প্রান্তে স্টিলের পাত ব্যবহার করা হবে। স্টিলের পাতে আঘাত করার পর ঢেউ দুর্বল হয়ে পড়বে। বাঁধ থাকবে সুরক্ষিত।
প্রকল্পের দলিল অনুসারে পুরো ভাসানচরে ১,৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস রয়েছে।
প্রতিটি ক্লাসটারে রয়েছে ১২টি বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ১৬টি ঘর। প্রতিটি ঘরে চারজন হিসাবে একটি বাড়িতে ৬৪ জন মানুষ বাস করতে পারবে। প্রতিটি ঘরের আকৃতি ১৪ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট চওড়া।
প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে একটি করে আশ্রয়েকেন্দ্র। জরুরি প্রাকৃতিক সমস্যায় এই কেন্দ্রগুলোতে মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
জরুরি প্রয়োজনে কাউকে সরিয়ে নিতে হলে দুটি বড় জাহাজ ও ২০টি হাই স্পিডবোট থাকবে। নির্মাণ করা হয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক মানের হেলিপ্যাড।
প্রকল্পের ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, বাঁধ দেয়ার কারণে ভাসানচরে কোনো লবণাক্ততা নেই। সেখানে স্বাদু পানির মাছ চাষ হচ্ছে। চরে গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালনের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা ২৩ অক্টোবর ভাসানচর সফর করে চরটির উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন।
তবে ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিসের বহির্বিভাগ প্রচার ইউনিটের কর্মকর্তা যোসেফ ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “সরকারের সাথে আমাদের একটা টেকনিক্যাল টিম ভিজিট করেছে। এ রকম আরও ভিজিট দরকার। ভাসানচর বাসযোগ্য হয়েছে কিনা সেই মন্তব্য এখন করা যাচ্ছে না। কারণ দ্বীপের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আমরা জানি না।”
ধোঁয়াশায় রোহিঙ্গারা
চলতি বছরের মধ্যে কক্সবাজার থেকে একলাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসান চরে স্থানান্তরের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এই দ্বীপ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি রোহিঙ্গাদের।
১১বছর আগে জেগে ওটা এই দ্বীপে আদৌ বসবাস করা যাবে কিনা, বর্ষায় বন্যা কবলিত হবে কিনা সেই সব শঙ্কা কাজ করছে রোহিঙ্গাদের মনে।
তবে রোহিঙ্গা নেতারা দেখে আসার পর যদি দ্বীপটিকে বসবাসযোগ্য মনে করেন তাহলে অনেকেই ভাসানচরে যেতে রাজি আছেন।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের ডিডি-১ ক্যাম্পের হেড মাঝি মো. আয়াছ বেনারকে বলেন, “খবরে শুনেছি ওই দ্বীপের চারিদিকে পানি। মাঝখানে এ দ্বীপ। ওখানে যাব না; মরলে এখানে মরব।”
তিনি বলেন, “এখানে সবাই মিলে এক জায়গায় আছি। চাইলেই সবার সাথে দেখা-সাক্ষাত করতে পারি। ওখানে সেটা সম্ভব হবে না।”
আয়াছ বলেন, “আমার বাবা ও চাচা থাকেন জামতলী ক্যাম্পে। বোন থাকে মুচনী ক্যাম্পে। আর আমি থাকি কুতুপালং। আমি ওখানে কেন যাব? আর ওই দ্বীপ সম্পর্কে আমরা এখনো ভাল-মন্দ কিছুই জানি না। শুধু খবরে শুনেছি।”
উখিয়ার তিন নম্বর ক্যাম্পের ডি.ডি (হাফ)-২ এর হেড মাঝি জোর মুল্লুক বেনারকে বলেন, “ওখানে বাড়ি-ঘর বানিয়েছে, অনেক কিছু করেছে শুনেছি। তবে দেখিনি। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে অবশ্যই সেখানে যাব। সবার আগে আমি চলে যাব। এখানে ভিড় বেশি। বাড়ি ঘর ছোট।”
তিনি বলেন, “এখানে ২০জনের জন্য একটা টয়লেট। জায়গার অভাবে টয়লেট তৈরি করা যাচ্ছে না।”
মুল্লুক বলেন, “আশা করি ভাসানচরে সেরকম হবে না। সেখানে নিরিবিলিতে বসবাস করা যাবে। সব ঠিকঠাক থাকলে আমিই সবার আগে চলে যাব।”
তিনি বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার আগে মাঝিদের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে নিয়ে যাওয়া দরকার। মাঝিরা গিয়ে যদি দেখেন সব ঠিক-ঠাক আছে তাহলে তাদের কথায় সবাই যেতে রাজি হবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।