রোগব্যাধিতে একশো দিনে প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গার মৃত্যু
2017.12.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
সরকারি হিসেবে, গত প্রায় ১০০ দিনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন রোগে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে দুজন এইডস এবং ছয়জন ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল।”
“মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তারা কখনো রাখাইনে রোগ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করেনি। এ কারণে তারা নানা রোগে আক্রান্ত,” বেনারকে বলেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মো. শাহীন আবদুর রহমান।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৪৭ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, রোহিঙ্গারা ডায়ারিয়া, আমাশয়, পোলিও, হেপাটাইটিস এ এবং ই, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, কলেরা, হাম, কালাজ্বর, গুটি বসন্ত, চর্মরোগ, এইডস ও ডিপথেরিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত। বেশির ভাগই পানিবাহিত ও ছোঁয়াচে রোগ। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু।
অপুষ্টির শিকার ২১ হাজার
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে, ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপুষ্টির শিকার ২০ হাজার ৯৩৬ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে।
“আপাতত ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা পূরণ করা আর সংক্রামক রোগের টিকাদান কর্মসূচি চলছে। এ মুহূর্তে অপুষ্টি নিয়ে সেভাবে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়,” জানান আবদুস সালাম।
“রোহিঙ্গাদের শতকরা ৮০ ভাগ শিশু মূলত অপুষ্টিতে ভুগছে। কারণ বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মায়েদের ছয় থেকে ১১ জন সন্তান। মায়েরাও অপুষ্টির শিকার বলে তারা বুকের দুধ খাওয়াতে পারছে না,” বেনারকে বলেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সাঈদ শিমুল।
জাতিসংঘ শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, অপুষ্টির কারণে শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি তারা ভবিষ্যতে নানা রোগে আক্রান্ত হবে।
ইউনিসেফ কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ ফারিহা সেলিম বেনারকে বলেন, “আমরা কোনো শিশুকে যখন অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখি তখন তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই।”
রোহিঙ্গাদের রোগ-বালাই
গত বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালংয়ে সেনাবাহিনী পরিচালিত মেডিকেল ক্যাম্পের সামনে লম্বা লাইন। সেখানেই কথা হয় রাখাইনের তামারবিল থেকে আসা সুফিয়ার সঙ্গে।
গুলশান পাহাড়ের ই ব্লকে স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে বসবাসকারী সুফিয়া বলেন, “মাথা গোঁজার ঠাঁই ও খাবার মিলেছে। পাশেই টিউবওয়েল ছিল। তবে কাছাকাছি টয়লেট ছিল না। গত ১৫ দিন ধরে টিউবওয়েলটি অকেজো হয়ে রয়েছে। এরপর থেকে পরিবারের তিনজনের ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে।”
রেডক্রিসেন্টের স্বাস্থ্য কর্মী তানজিমা বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন আমরা প্রায় ১ হাজার রোহিঙ্গাকে স্বাস্থ্যসেবা দেই। তাদের অধিকাংশই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।”
এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও মো. শাহীন আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন গড়ে সদর হাসপাতালে ২৫০ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এদের অধিকাংশই সর্দি, জ্বর, কাশি, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।”
এইসব রোগীদের ৭০ ভাগই শিশু বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম।
“পলিথিনের ঘর আর শীতের পোশাকের অভাবে সর্দি জ্বর, কাশি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লেগেই আছে,” বেনারকে বলেন কুতুপালংয়ের আমতলী রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গা নারী শাকিলা।
এদিকে পানীয় জল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার সংকট এবং অসচেতনতার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
১০৭ জন এইডস রোগী
এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১০৭ জন এইডস রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৫জন পুরুষ, ৫৫জন নারী ও ১৭জন শিশু রয়েছে। রোহিঙ্গাদের এইডস আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে এসব তথ্য বেনারকে দিয়েছেন বেসরকারি সেবা সংস্থা আশার আলোর এইচটিসি কাউন্সিলর প্রভাষ পাল।
তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এইডস আক্রান্ত তিনজন গর্ভবতী নারী রয়েছেন। তারা এ মাসের শেষে সন্তান প্রসব করতে পারেন। তাদের আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। চেষ্টা করছি যাতে আগত সন্তানদের শরীরে এইডসের জীবাণু না থাকে সেই ব্যবস্থা করার।”
কক্সবাজারের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শাহীন আবদুর রহমান বলেন, “এ পর্যন্ত এইডসের কারণে দুজন রোহিঙ্গা মারা গেছেন। তিনজন শেষ ধাপে রয়েছেন। আমরা এইডস রোগীদের জীবনমান ও প্রাত্যহিক আচরণ পরিবর্তনে কাজ করছি।”
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া ডিপথেরিয়া রোগীর সন্ধান মিলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এ রোগে ৭২২ জন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে গত এক মাসে মারা গেছেন ৯ জন।
“ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি ডিপথেরিয়ার মহামারি ঠেকাতে গত মঙ্গলবার থেকে উখিয়া ও টেকনাফের ৬০ টি মেডিকেল ক্যাম্পে টিকা দেওয়া হচ্ছে। ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে এই টিকা দেওয়া হবে,” জানান কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. সালাম।
স্বাস্থ্য বিভাগ গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত যক্ষ্মায় আক্রান্ত ৭৪ জনসহ অন্য রোগে আক্রান্ত মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৭৭ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩ হাজার নারী এ দেশে এসে সন্তান প্রসব করেছেন। এ ছাড়া এই মুহূর্তে গর্ভবতী নারী রয়েছেন আরও ২২ হাজার।
সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম জানান, রোহিঙ্গাদের চিকিৎসায় ১০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইন্টার্নি চিকিৎসক এবং মেডিকেল ছাত্রসহ প্রায় ২ হাজার জনবল কাজ করছে।