মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ৩ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা

জেসমিন পাপড়ি ও তুষার তুহিন
2017.12.15
ঢাকা ও কক্সবাজার
বালুখালি শরণার্থী শিবিরে শিশু কোলে পূর্ণিমা দেখছেন এক রোহিঙ্গা নারী। বালুখালি শরণার্থী শিবিরে শিশু কোলে পূর্ণিমা দেখছেন এক রোহিঙ্গা নারী। ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭।
রয়টার্স

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি বিরাট অংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। সরকারি হিসেব বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এখন পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি মানসিক সমস্যা আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা মানসিক সমস্যায় ভুগছে এমন ৩ হাজার ২৪২ জন রোহিঙ্গাকে খুঁজে পেয়েছি।”

“বর্বর হামলার শিকার হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে,” মনে করেন তিনি।

“এসব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের সেবা দিতে উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেন্টাল হেলথ সেন্টার খোলা হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চিকিৎসাসেবা সংস্থা মেডেসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়েরস (এমএসএফ), এসিএফ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কাউন্সিলররা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে কাজ করছে,” বেনারকে জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন।

মানসিক রোগীদের সেবা দিতে সরকারি ২ জন মানসিক চিকিৎসকসহ মোট ৫ জন সাইকিয়াট্রিস্ট ও দেড় শতাধিক কাউন্সিলর কাজ করছে বলে জানান তিনি।

এসব মানসিক রোগীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি বলে বেনারকে জানান জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মাহমুদা। দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানসিক সেবা দেওয়ার কাজ করছেন তিনি।

মাহমুদা বলেন, “বর্বরতার শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বেশি লক্ষ করা গেছে। শুরুতে মানসিক চিকিৎসা সেবা পেয়ে এদের বিরাট একটি অংশই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছেন।”

একই দিনে তিন সন্তান, স্ত্রী ও মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী ছৈয়দ হোসেন। ২৫ নভেম্বর ২০১৭।
একই দিনে তিন সন্তান, স্ত্রী ও মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী ছৈয়দ হোসেন। ২৫ নভেম্বর ২০১৭।
তুষার তুহিন/বেনারনিউজ

 

নির্বাক হয়ে আছেন তাঁরা

উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের আমতলী ক্যাম্পে মায়ের সাথে এসে আশ্রয় নিয়েছেন ১৩ বছরের জমিলা আকতার। এসেছেন বুচিদং থেকে। চোখের সামনে নির্মমভাবে বাবাকে খুন হতে দেখা এই কিশোরী নিজেও হয়েছেন গণধর্ষণের শিকার।

এপারে এসে চিকিৎসা নিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে এখনো বিপর্যস্ত জমিলা।

মেয়ের প্রসঙ্গে নির্যাতিতার মা নুরবানূ বেনারকে বলেন, “আমার মেয়েকে আমার ও আমার স্বামীর সামনে ধর্ষণ করেছে রাখাইনের সেনাবাহিনী। আমার স্বামী বাধা দিলে তাকে মেরে ফেলে তারা। এ দৃশ্য আমার মেয়ের চোখের সামনে ঘটেছে। সেই থেকে সে আর কারো সঙ্গেই কথা বলে না। অপরিচিত লোকজন দেখলে ভয়ে আঁতকে উঠে। জানি না কবে স্বাভাবিক হবে সে।”

টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং ক্যাম্পে বি ব্লকে আশ্রয় নিয়েছেন রাখাইনের তামারবিলের ছৈয়দ হোসেন (৩৫)।

এদেশে আসার পর থেকে মূর্তির মতো বসে থাকেন তিনি। হঠাৎ হঠাৎই যাকে-তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। বন্দুক, জিপ গাড়ি দেখলেই চিৎকার করে উঠেন।

ছৈয়দ হোসেনের বন্ধু জামাল উদ্দিন বেনারকে জানান, “তিন সন্তান, স্ত্রী আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে রাখাইনে ছৈয়দের সুখের সংসার ছিল। কিন্তু ইদুল আযহার আগের শুক্রবার সেনাবাহিনী তার মা, সন্তান ও স্ত্রীকে হত্যা করে বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় ও শোকে হতবিহ্বল ছৈয়দ হোসেন বারবার জ্ঞান হারান। তখনি আমরা ছৈয়দের জীবন বাচাঁতে তাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসি।

“স্ত্রী-সন্তান আর মাকে হারিয়ে মানসিক সমস্যায় ভুগছে ছৈয়দ। ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখলে তাদের ধরতে ছুটে যায়। কেউ কথা বলতে গেলেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাদঁতে শুরু করে। আগ্নেয়াস্ত্রসহ পোশাকধারী কাউকে দেখলেই সে চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠে। দিনে দিনে তার মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে,” জানান জামাল।

এসব মানসিক রোগীদের মধ্যে বিরাট একটি অংশ শিশু বলে জানান স্বাস্থ্যকর্মীরা।

সরেজমিনে কুতুপালংয়ের মধুরছড়ার গুলশান পাহাড়ে হৈ হুল্লোড় আর খেলাধুলায় মত্ত একদল রোহিঙ্গা শিশু থেকে অল্প দূরে আনমনে বসে থাকতে দেখা যায় ১২ বছর বয়সী শিশু রফিককে।

রাখাইনে আর্মির হাতে বাবা মাকে হরিয়ে দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের সঙ্গে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে সে।

সেই আত্মীয় শওকত আলী বেনারকে বলেন, “সাড়ে তিন মাস আগে এক শুক্রবারে রাখাইনের মংডুতে তাদের গ্রামে প্রথম হামলা করে মিলিটারিরা। বিকেলের সেই হামলায় রফিকের চোখের সামনে তার বাবা মাকে গুলি করে মেরে ফেলে তারা। এরপর থেকে তেমন কারো সঙ্গে কথা বলে না রফিক। সবসময় আনমনা হয়ে থাকে।”

বালুখালি শরণার্থী শিবিরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক রোহিঙ্গাকে সেবা দিচ্ছে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭।
বালুখালি শরণার্থী শিবিরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক রোহিঙ্গাকে সেবা দিচ্ছে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭।
তুষার তুহিন/বেনারনিউজ

 

চিকিৎসা এক দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া

বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সালাহ্‌উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বেনারকে বলছিলেন, “কোনো কোনো জরিপে দেখা গেছে, বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ৪ শতাংশ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত শরণার্থী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে যায়। এর জন্য অতীত স্মৃতি যেমন দায়ী তেমনি ক্যাম্পে স্বাভাবিক জীবন না পেয়েও হতে পারে।”

“অসুস্থতার ধরন নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মানসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা জরুরি। আর যারা এখনো সুস্থ আছে তারা যাতে অসুস্থ হয়ে না পড়ে সেজন্য সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সেটা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যতটুকুই সম্ভব,” মনে করেন এই মনোরোগ চিকিৎসক।

রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী শারমিন আকতার বেনারকে বলেন, “শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই রাখাইনে স্বজনদের হারিয়েছেন। স্বচক্ষে দেখেছে আপনজনদের হত্যার দৃশ্য। তারা যেন ফেলে আসা অতীত ভুলে যেতে পারে সেই চেষ্টা করছি আমরা।”

এমএসএফ (ফ্রান্স) এর কক্সবাজারের মুখপাত্র সেলিম বাদশা বেনারকে বলেন, “আমাদের সংস্থা এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে মানসিক চিকিৎসা দিয়েছে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতির চেয়ে ভিন্ন।”

সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বলছিলেন, “একজন মানসিক রোগীর সঙ্গে প্রথমে মানসিক রোগের ডাক্তার কথা বলে তাঁর সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করার পাশাপাশি নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। মানসিক রোগীদের চিকিৎসা একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া।”

“এই চিকিৎসায় রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার, সুন্দর আচরণ করা জরুরি। এছাড়া রোগীকে তার অতীত মনে না করানো, ফেলে আসা স্মৃতি ভুলে থাকতে তাকে কর্মব্যস্ত রাখা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা করানোসহ নানা কাজ করে থাকেন চিকিৎসকরা,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।